মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ভাবনা

আমাদের সমাজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ অবহেলা ও সামাজিক বঞ্চনার স্বীকার হয় প্রতিনিয়ত। তাদের ভাবা হয় অক্ষম ও অযোগ্য। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষও যে সমাজের একটি অংশ এমন ধারণা পোষণকারী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সামাজিক, মানসিক সব প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে কিছু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও তাদের ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান বুলবুল
নতুনধারা
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে হবে

মো. আলিফ হোসেন

ইতিহাস বিভাগ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণের কোনো বিকল্প নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণে মনোনিবেশ করতেই হবে, কারণ বাংলাদেশের পেক্ষাপটে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্র খুবই সীমিত। তাই বিকল্প কার্যকর পন্থা হিসেবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রযুক্তি খাতকে বেছে নিতে পারে। প্রযুক্তি খাতে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সর্বপ্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, স্কিল অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্ক্রিন রিডার সাপোটিভ প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। যেমন- জস, এনভিডিএ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শী হতে হবে। এছাড়াও আধুনিক বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে সহায়ক উপকরণগুলো পাওয়া যায় সেগুলোতে নিজেদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে তারাও প্রযুক্তিগত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে প্রেজেন্ট করবে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তি খাতে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। যদি এই বিপুল সংখ্যক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা যায় তাহলে তারাও দক্ষ মানব সম্পদে রূপান্তরিত হবে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাম্পাস চাই

ফয়সাল মোহাম্মদ ইব্রাহিম

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অসাধারণ।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পেরে আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা গর্বিতবোধ করি সবসময়।

যদিও এত প্রাপ্তির ভিড়ে কিছু অসুবিধাও আমাদের হয়। প্রতিবার পরীক্ষার আগে শ্রম্নতিলেখক পেতে আমাদের খুব অসুবিধা হয়।

তার সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রম্নতিলেখকের অনুমতি পেতে প্রশাসনিক জটিলতা। এই জটিলতা কিছুটা কমানো গেলে

আমাদের প্রতি পরীক্ষার আগে এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না।

এছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদের

অন্তর্ভুক্ত করা হয় না বললেই চলে। এই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারলে আমরা নিজেদের সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে আরও বিকশিত করতে পারতাম।

এবং বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ

আমাদের আরও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা গেলে

আমরাও যে কিছু পারি তা প্রমাণ করার

সুযোগ পেতাম।

এমন অল্প কিছু ছোট ছোট উদ্যোগ নিলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে

আমি মনে করি।

\হ

ব্রেইল বুক সহজলভ্য করা হোক

মো. রাশেদুল শেখ

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ব্রেইল পদ্ধতির। কিন্তু এই পদ্ধতিতে লেখাপড়া করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। ব্রেইল সরঞ্জাম ব্রেইল পেপার এবং ব্রেইলে লেখার যন্ত্র এখনো অপ্রতুল ফলে এই পদ্ধতিতে পড়াশোনা করার জন্য আর্থিক অবস্থা ভালো না হলে সমস্যায় পড়তে হয়।

আমরা যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তাদের জ্ঞান আহরণের জন্য ব্রেইল বুক সহজলভ্য করা দরকার এ বিষয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহযোগিতার হাত প্রসার করতে হবে।

বর্তমানে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে ব্রেইল বই বিতরণ করলেও। উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্রেইল বইয়ের সরঞ্জাম সরকারিভাবে অথবা বেসরকারিভাবে বিতরণ করা হয় না। তাতে করে আমাদের লেখাপড়া প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে আমাদের অনেক ধরনের বই পড়তে হয়। কিন্তু এর কোনো বই ব্রেইল পদ্ধতিতে তৈরি নেই। যদিও বা কিছু বই ব্রেইলে লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় তা আমাদের কোর্সের সঙ্গে বা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এতে আমার এবং আমার সহপাঠীদের লেখাপড়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পয়েছে। তাই আমি মনে করি যদি সরকারি এবং বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ব্রেইল বই বিতরণ করত উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাহলে আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পথ আরও সহজ হতো এবং আমরা খুব সহজেই জাতির মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে পারতাম।

কর্মক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের

অগ্রাধিকার প্রদান করা হোক

আবু সাহেদ

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অনেক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে যখন কর্মজীবন শুরু করতে যায় তখন তার পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের চাকরি দিতে অসম্মতি জানায়।

তারা অজ্ঞতাবশত মনে করে আমরা কাজ করে অসমক্ষ। আবার যখন আমরা সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করি তখন আমাদের প্রচলিত নিয়োগ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে চাকরি পেতে হয়। এতে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর আর চাকরি পাওয়া হয় না। যদিও শিক্ষার উদ্দেশ্য চাকরি না তবুও জীবন জীবিকার তাগিদে মানুষকে কিছু করতে; কিন্তু আমাদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ধরনের নিয়োগ পদ্ধতির সিস্টেম চালু আছে। একজন স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ একজন স্বাভাবিক মানুষ সহজে বিভিন্ন স্থানে যেতে পারে। তারা সহজে বিভিন্ন বই পড়তে পারে তাদের জন্য চাকরির কোচিং সেন্টার পর্যন্ত আছে।

অন্যদিকে আমাদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয় বই অপ্রতুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১ হাজারের মতো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে বর্তমানে তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার অনিশ্চিত। তাই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট অনুরোধ করছি আপনারা আমাদের জন্য বিশেষ শিথিলযোগ্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করুণ।

বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও অনেক দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম। তাই আমাদের কর্মক্ষেত্রে সুযোগ দিয়ে আমাদের মেধা ও সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর সুযোগ দেবেন।

জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধী অধিকার সনদের সঠিক বাস্তবায়ন চাই

বিশ্বজিৎ বসাক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ১৩ ডিসেম্বর ২০০৬ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ অনুমোদন করা হয়। ৫০টি আবশ্যিক ধারা ও ১৮টি ঐচ্ছিক প্রতিপালনীয় বিধিবিধান সংবলিত এ সনদ বৈষম্য, উপেক্ষা, দমনপীড়ন আর নির্যাতনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা প্রতিবাদ ও সমান অধিকারের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে বেশকিছু মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এ অধিকার সনদের লক্ষ্য হলো সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পূর্ণ ও সমান মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলো চর্চার প্রসার, সুরক্ষা ও সুনিশ্চিতকরণ। তাদের চিরন্তন মর্যাদার প্রতি সম্মান সমুন্নত করা, সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে যে কোনো ভেদাভেদ বর্জন অথবা নিষেধাজ্ঞা, যার উদ্দেশ্য বা পরিণতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অন্যদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক অথবা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রের সব মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলোর স্বীকৃতির উপভোগ বা অনুশীলনে বাধাগ্রস্ততা বিলোপ সাধন এ সনদের মূল প্রতিপাদ্য। বাংলাদেশ এ অধিকার সনদের ৯১তম রাষ্ট্র হিসেবে স্বাক্ষর এবং ৮ম শরিক রাষ্ট্র হিসেবে অনুস্বাক্ষর করেছে। ৩ মে ২০০৮ থেকে এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন হিসেবে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন এবং মানবাধিকারের ধারাগুলো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। এগুলোর প্রতিফলন প্রায় সময় হয় না। অজ্ঞতার কারণে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে এখনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিগৃহীত হতে হয়।

আমি জনপ্রশাসন ও সরকারের কাছে আহ্বান করব জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধী অধিকার সনদের বাস্তবায়নে সচেতন হতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে