শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তারুণ্যের ভাবনায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ

পুরুষশাসিত সমাজের এক ভয়ংকর ব্যাধির নাম নারী নির্যাতন! প্রতি বছর পালন করা হয় নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সচেতন শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন? এ বিষয়ে তাদের অভিমত তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রহমান
নতুনধারা
  ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

সমবেত প্রচেষ্টা প্রয়োজন

মোমেনা আক্তার

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ,

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

নানাবিধ সচেতনতার পরও দেশে এখনো নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা চলমান। ধর্ষণ, গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার মতো নির্যাতনও বাড়ছে। যা বর্তমান সমাজে দিন দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। নারী যে আমাদের মা, বোন, মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মেশানো একজন মানুষ- তা তাদের মন থেকে সরে গিয়ে ভোগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আইনের দুর্বলতায় পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষণ-নির্যাতনের আসামিরা। যে কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। আর তাই এ বিষয়ে প্রশাসনকে হতে হবে আরও কঠোর। নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনও খুব বেশি জরুরি। মানুষের মধ্যে যদি হিংস্রতা থাকে, বর্বরতা থাকে তাহলে নারীর প্রতি নির্যাতন বেড়েই যাবে।

সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা এবং দৃশ্যত এই প্রতিরোধ জারি রেখে সচেতনতা তৈরি করার বিকল্প নেই। নারীদের এ সম্মান ও সুরক্ষার দায়িত্ব শুধু নারীদের হতে পারে না। সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সমবেতভাবে মর্মভেদী এ আক্রমণকে একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে।

মানুষ হিসেবে বিবেচনা করুন

মো. তাসনিম হাসান আবির

শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দিবস পালনের যেন অন্ত নেই। কিন্তু আদৌ কী নারী নির্যাতন কমেছে? না, বরং বেড়েই চলেছে! শিশু-কিশোরীরা নিয়মিত ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যার স্বীকার হচ্ছে। কারণ, সমাজের কিছু মানুষ এখনো নারীকে শুধু শরীর হিসেবেই বিবেচনা করে। যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের সামগ্রী মনে করে।

তাছাড়া কঠোর আইন প্রয়োগের অভাবও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনার যদি দ্রম্নত, সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় তাহলে অপরাধী অপরাধ করতে ভয় পেয়ে সরে আসবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অপরাধীরা বেশির ভাগ সময়ই ক্ষমতার দাপটে আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিচার থেকে বের হয়ে আসে এবং ওই মামলা আর আগায় না। ফলে বছরের পর বছর নির্যাতিতা পরিবার আদালতের চত্বরে ঘুরে-ফিরে। অনেক সময় মানুষের কটু কথা, সমাজের লাঞ্ছনা সইতে না পেরে আত্মহননের পথও বেছে নেয়। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা তখনই কমবে যখন সমাজের মানুষ নারীকে শুধু শরীর হিসেবে বিবেচনা না করে একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করবে এবং আইনের যথার্থ প্রয়োগ হবে।

আইনি ব্যবস্থা জোরদার করুন

ুআয়েশা সিদ্দিকা

শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সময়ের প্রবাহমান স্রোতে পুরুষকে শক্তি জোগানো নারীরাই হয়ে আসছে নির্যাতনের শিকার নীরব দর্শক। বর্তমানেও জনজীবন থেকে শুরু করে সবকিছু শিথিল থাকলেও শিথিল নেই নারী নির্যাতনের মাত্রা। ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা বাড়ছেই। সমাজে কাপুরুষোচিত কিছু ব্যক্তি মনে করেন, নারী মানেই ভোগ-লালসার বস্তু। তাই নারীর উপর ক্ষমতা বা প্রভুত্ব সৃষ্টিতে তারা বেছে নেয় নারী নির্যাতনের পথ। দেশে বহু নারী-হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা তদন্ত নামের বিচারের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। যার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতা। যারা নারী নির্যাতন করছেন, তারা আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতায় পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে নির্যাতিত নারীদের জীবন হয়ে পড়ছে দুর্বিষহ। তাই এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থাকে কঠোর ও সঠিক হতে হবে। যেখানে নারী নির্যাতন সংগঠিত হবে, সেখানে শুধু প্রশাসন নয়- স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কঠোর শাস্তির বিধান রাখতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

ুঅনিল মো. মোমিন

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ,

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

যুগে যুগে অবহেলিত নারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে ঘর থেকে বেরোতে পারলেও তার উপরে আসা নির্যাতন থেকে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, যৌন নিপীড়ন, বাল্যবিয়ে, অপহরণের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিকতা, সংস্কার আর বিধিনিষেধের বেড়াজালে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইনে সাইবার বুলিং নারী নির্যাতনের আরেকটি ধরন। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি মর্গেও নারীরা নিরাপদ নয়।

যৌতুক কিংবা পুরুষত্বের বিস্তারে নুন থেকে চুন খসলেও উষ্ঠা-লাথিসহ বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হয় নারীদের। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতন সবচেয়ে ভয়াবহ। নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও সামাজিক অবক্ষয় নারী নির্যাতন বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক।

বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারিতে দেশে এ সব নির্যাতনের পরিমাণ আগের তুলনায় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই নিজেদের প্রয়োজনেই এসব বন্ধ করতে হবে। নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। কঠোর আইনপ্রয়োগের পাশাপাশি নারীর প্রতি আমাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদের আত্মমর্যাদা নিশ্চিত করাও এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সুস্থ মানসিকতা জরুরি

ুনাঈমা আক্তার রিতা

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক সংগঠন হলো পরিবার। আর এই পরিবারগুলোই যুগ যুগ ধরে নারী নির্যাতনকে লালন করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সংসারে ছেলের বউকে নির্যাতন নিয়ে পরিবারের ভ্রূক্ষেপ নেই অথবা নিজ ছেলের ইভ টিজিং, ধর্ষণের বিরুদ্ধেও রয়েছে পরিবারের মৌন সম্মতি। নিজের পরিবারে অন্যের মেয়ের নির্যাতন নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হয় তখন, যখন নিজের মেয়ে নির্যাতনের শিকার হয় অন্যের দ্বারা। তখনই বিচারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সর্বপ্রথম এমন বিকৃত মস্তিষ্কের অসুস্থ চিন্তা-ভাবনাকে পরিবর্তন করা দরকার। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হবে। যদি নারী নির্যাতন সত্যিকার অর্থেই প্রতিরোধ করতে হয় তবে উৎপত্তিস্থল থেকেই স্বমূলে উৎপাটন করতে হবে। হাজারো আইন নয় বরং প্রতিটি পরিবারের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও সুস্থ মানসিকতা নিমিষেই পারবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে। পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নিশ্চিতসহ স্বজনপ্রীতি পরিহার করতে হবে। সর্বোপরি, পারিবারিক সুস্থ মানসিকতা গড়ে তোলাই হোক নারী নির্যাতন প্রতিরোধের একমাত্র প্রধান হাতিয়ার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে