বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধে নবীনদের অনুভূতি

প্রায় সব শিক্ষার্থীর জীবনে স্বপ্ন থাকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের। সেই স্বপ্ন পূরণের পথ ফুল বিছানো নয়। কণ্টকাকীর্ণ পথপ্রান্তর পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের পর জায়গা করে নিতে হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিতে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই নয়, লড়তে হয়েছে মহামারি করোনার সঙ্গেও। কিন্তু দীর্ঘ লড়াই শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পর আবারও নেমে এলো করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের থাবা। স্বপ্নের ক্যাম্পাসে পা রাখতে না রাখতেই থমকে গেলো স্বপ্নযাত্রা। থেমে গেল ক্যাম্পাসে নবীনদের কোলাহল। তাই তো ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা নবীন কিছু শিক্ষার্থীদের অনুভূতি তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী মিনহাজুল ইসলাম

প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
প্রিয়াঙ্কা আহাদ প্রান্তি
রঙিন স্বপ্নগুলো মুহূর্তেই সাদা-কালো প্রিয়াঙ্কা আহাদ প্রান্তি শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একজন মানুষের শিক্ষাজীবন শুরু হয় জন্ম থেকে। কিন্তু ছাত্রজীবন শুরু হয় তখন থেকে যখন কেউ তার চারপাশটা বুঝতে শেখে। ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই অনেক শিক্ষার্থী মনে মনে একটি স্বপ্নের ঠিকানা নির্বাচন করে রাখে। কারও স্বপ্ন থাকে মেডিকেল কলেজ, কারও স্বপ্ন থাকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, আবার কারও স্বপ্ন থাকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। এই স্বপ্নের ঠিকানাকে বাস্তবে রূপদান করাটা একজন শিক্ষার্থীর অনেক বছরের সাধনার ফল। আমি এইচএসসি-২০২০ ব্যাচের একজন ছাত্রী হিসেবে আমার লক্ষ্য অর্জনের পথে করোনাভাইরাস নামক যে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই প্রতিবন্ধকতা ধৈর্যের সঙ্গে অতিক্রম করে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীর দু'চোখ ভর্তি কৌতূহল থাকে, থাকে উত্তেজনা। এই কৌতূহল, এই উত্তেজনা তার নতুন ক্যাম্পাস ও নতুন জীবনকে ঘিরেই। কিন্তু চারপাশের রঙিন স্বপ্নগুলো মুহূর্তেই সাদা-কালো হয়ে গেল যখন সরকার থেকে ঘোষণা এলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করতে হবে। ছাত্রজীবনের এক নতুন অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আমরা আরেকটি বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তাহলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু লেকচারের মাধ্যমেই জ্ঞানদান করেন না; তাদের ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, ছাত্রছাত্রীদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, মুগ্ধ করতে পারে। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের জন্য এ বিষয়গুলো আমাদের নিকট অধরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সামাজিক কল্যাণ এবং স্ব-উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত থাকে আমরা সেগুলো থেকেও এখন পর্যন্ত বঞ্চিত, যা ক্যাম্পাসে সদ্য পা রাখা শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখজনক। সবশেষে আশা থাকবে দ্রম্নতই পৃথিবী সুস্থ হয়ে আসবে এবং বিদায় নেবে ওমিক্রন। আর আমাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে স্বপ্নের ক্যাম্পাস। সব কল্পনা আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন মরীচিকার মতো মো. ইকরামুল হক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি মানুষের জীবনেই একটি নির্দিষ্ট স্বপ্ন থাকে আমিও এর ব?্যতিক্রম নই। সেই ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি একটি প্রবল আকর্ষণ ছিল। আর মায়ের মুখে তো শুনতামই 'লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে'। সব মিলিয়ে একটা ভালোলাগার মধ?্যদিয়েই প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পার করে পা দিলাম মাধ্যমিক এবং ক্রমানুসারে উচ্চমাধ?্যমিক শিক্ষাজীবনে। তখনই ধীরে ধীরে আমার লেখাপড়ার প্রতি ভালোবাসা আরও প্রবল হলো। যখনই শিক্ষকদের মুখে শুনতাম উচ্চশিক্ষা, ইউনিভার্সিটি লাইফ ইত্যাদি তখনই আমার অন্তরে জায়গা করে নিল বিশাল বিশাল স্বপ্ন। আমি শুরু করলাম কঠোর পরিশ্রম। যার ফলস্বরূপ আজ আমি আমার স্বপ্নের ক?্যাম্পাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের একটা স্থান করে নিতে পেরেছি। যার অনুভূতি বলে প্রকাশ করা দুরূহ। আমি আমার স্বপ্নের ক্যাম্পাসটি নিয়ে প্রতিদিন কল্পনা করি। শুধু অপেক্ষায় থাকি কবে আমার নতুন বন্ধু-বান্ধব, নতুন ক্লাস, শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচিত হবো। কিন্তু তখন থেকেই আমার সব কল্পনা আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন মরীচিকার মতো মনে হচ্ছে, যখনই শুনলাম মহামারি ওমিক্রনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দুই সপ্তাহের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন আমার মনে এক অজানা আতঙ্ক ও ভয় বিরাজ করছে, 'আমার স্বপ্নের ক?্যাম্পাস মুখরিত হবে তো আমাদের পদচারণায়?' দিন গুনছি কবে আসব স্বপ্নের ক্যাম্পাসে আঁখি আক্তার বন্যা শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেই ছোট্টবেলায় স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয়েছিল শিক্ষাজীবন। স্কুলজীবনের সেই সুখকর অনুভূতিগুলো হয়তো লিখে প্রকাশযোগ্য নয়। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি। একসময় স্কুল-কলেজজীবন পেরিয়ে স্বপ্ন দেখলাম উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। তারপর থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। দিনরাত চলে অক্লান্ত পরিশ্রম। অনেক প্রচেষ্টা, মা-বাবার দোয়া, শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা এবং নিজের পরিশ্রমের ফল হিসাবে সুযোগ পেলাম দেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের। যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলাম, সেদিনের অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মতো নয়। এটা হয়তো জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ছিল। দু'চোখে রঙিন স্বপ্ন আর একবুক আশা নিয়ে দিন গুনছিলাম কবে আসব স্বপ্নের ক্যাম্পাসে। নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধু-বান্ধবী সবার সঙ্গে পরিচিত হবো। ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু বিধি বাম! সব স্বপ্ন যেন এক নিমিষেই ফিকে হয়ে গেল। ফেব্রম্নয়ারি মাসের ১০ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, মহামারি করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলো। এ যেন আমার জীবনে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই! ধূলিসাৎ হয়ে গেল আমাদের স্বপ্ন। কারণ আমরা জানি না কবে বন্ধ হবে ওমিক্রনের বিস্তার। আর কবে খুলে দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। আর এটাও জানিনা, কবে পা রাখতে পারব স্বপ্নের ক্যাম্পাসে। প্রথম পদার্পণ ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি খাঁন মাসুম বিলস্নাহ শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যদিয়েই শুরু হয় স্কুলজীবন? তখন স্কুলে যাওয়ার যে অনুভূতি বা ভালো লাগা তা ছিল অব্যক্ত? কেননা তখন আমি নিতান্তই ছোট ছিলাম? তখন অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা ততটা হয়তো ছিল না। এভাবে পার করি মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন? এরপর পদার্পণ করি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাজীবনে? তখন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার অনুভূতিটা একটু বেশিই অন্যরকম ছিল? কেননা এই সময়েই দু'চোখে ছিল রঙিন কিছু স্বপ্ন। কল্পনায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর সামনে চলে আসে এইচএসসি পরীক্ষা? আমি পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত? পরীক্ষার কিছু দিন আগে শুরু হয় করোনানামক মহামারির থাবা? তখন থেকেই শুরু হয় জীবনে হতাশা ও আতঙ্কের কালো অধ্যায়? করোনার কারণে পরীক্ষা পিছাতে পিছাতে এক সময় পরীক্ষাই বাদ দিয়ে অটো পাস দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধের পালা? উচ্চমাধ্যমিকে থাকা অবস্থায় সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তৈরি হয় আলাদা এক আকর্ষণ? ফলে নতুন উদ্যামে শুরু করি ভর্তি পরীক্ষার রণক্ষেত্রে টিকে থাকার প্রস্তুতি? ভর্তি পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখও অনেক বার পিছিয়েছে? যার ফলে প্রস্তুতি ধরে রাখাও ধৈর্যের পরীক্ষা ছিল? অবশেষে আলস্নাহর রহমতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছি? স্বপ্নের ক্যাম্পাসে প্রথম পদার্পণ ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি, যা প্রকাশযোগ্য নয়? ক্লাস করা, বন্ধু ও সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, ক্যাম্পাস ঘোরা সবই এক অন্যরকম অনুভূতি। অতীতের হতাশা-গস্নানি ভুলে নতুনভাবে শিক্ষাজীবন নিয়ে স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করি? কিন্তু ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা, জীবনে আবার সেই হতাশা ও অনিশ্চয়তার কালো অধ্যায়ের সূচনা করল? না জানি এর শেষ কোথায়! কবে আবার সুস্থ হবে প্রকৃতি। কবে আবার প্রাণ ফিরবে প্রিয় ক্যাম্পাসে।