দুখু মিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ক্যাম্পাস

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

মাত্র ৫৭ একরের এই ছোট ক্যাম্পাসটিতে রয়েছে চারটি আবাসিক হল, রয়েছে পাঁচ ও দশতলা বিশিষ্ট চারটি একাডেমিক ভবন। কবির স্মৃতিঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে নজরুল ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, জয়বাংলা ভাস্কর্য, চির উন্নত মম শির স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ মিনার। পাঁচতলাবিশিষ্ট সুসজ্জিত গ্রন্থাগার, গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ, চুরুলিয়া মঞ্চসহ সুবিশাল শেখ রাসেল খেলার মাঠ। এ ছাড়া মসজিদ, টিএসসিসহ বিভিন্ন ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। উৎসবমুখর বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক মননের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছরই নানা উৎসবের আমেজ থাকে

প্রকাশ | ২৮ মে ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে'। সত্যি কবিকে ভোলা যাবে না। তিনি বেঁচে থাকবেন প্রতিটি মানুষের অন্তরে। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়, তার কর্মে, তার বিদ্রোহী চেতনায়। কবির স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাল্যকালে প্রথম কবি এখানে এসেছিলেন। তাই কবি স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে কবির সম্মানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯০৮ সালে কবির পিতার মৃতু্যতে থমকে যায় তার জীবন। মাত্র আট বছর বয়সেই নামতে হয় কর্মক্ষেত্রে। শুরু হয় জীবনের সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম। আসানসোলের একটি রুটির দোকানে কাজ করার সময় কবির পরিচয় হয় পুলিশ কর্মকর্তা রমিজউদ্দিনের সাথে। কবি প্রতিভায় মুগ্ধ রমিজউদ্দিন ঠিকই বুঝেছিলেন এই ছোট বালক সাধারণ কোনো ছেলে নয়। তাই তো তাকে নিয়ে আসেন তার নিজ বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। কবির বাল্যকালের স্মৃতি বিজড়িত সেই ত্রিশালের নামাপাড়াতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবি নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ময়মনসিংহ বিভাগে অবস্থিত প্রথম সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন কিছু কথা : বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম ১৯৯০-এর দশক থেকে বেসরকারি খাতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কমিটি গঠন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একনেকের বৈঠকে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৫ সালের পহেলা মার্চের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৭ সালের ২৪ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে বেগম জিয়া দুটি অনুষদের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন এবং ৩ জুন ২০০৭ সালে প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার এবং ময়মনসিংহ থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নামাপাড়া এলাকায় অবস্থিত। বর্তমানে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত এই নজরুল তীর্থ। ৬ অনুষদের অধীনে রয়েছে ২৪ বিভাগ প্রতিষ্ঠাকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, সংগীত বিভাগ এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে সর্বমোট ১৮৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকম শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ শামসুর রহমান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬ অনুষদের অধীনে রয়েছে ২৪টি বিভাগ। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ : কম্পিউটটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরিসংখ্যান বিভাগ; ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ : হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও মার্কেটিং বিভাগ; সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ : অর্থনীতি, লোকপ্রসাশন ও সরকার পরিচালনবিদ্যা, ফোকলোর, নৃবিজ্ঞান, পপুলেশন সায়েন্স, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। আইন অনুষদ : আইন ও বিচার বিভাগ চারুকলা অনুষদ : চারুকলা বিভাগ নজরুল স্মৃতিতে জীবন্ত ক্যাম্পাস : কবির ছোঁয়া যেন এখনো লেগে আছে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে। রয়েছে কবির স্মৃতিঘেরা বটগাছ যেটা কিনা কবির স্মৃতির জীবন্ত উদাহরণ যেখানে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন। কবির বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জিনিসের নামকরণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের পরিবহণের জন্য রয়েছে বাঁধনহারা, প্রলয়শিখা, ধূমকেতু, প্রভাতি নামের বাস। উপাচার্যের বসবাসের জন্য রয়েছে দুখুমিয়া বাংলো। রয়েছে 'চির উন্নত মম শির' স্মৃতিস্তম্ভ, কবি নজরুল ভাস্কর্য, গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ, চুরুলিয়া মঞ্চ, 'ব্যথার দান' মেড়িকেল সেন্টার, অগ্নিবীণা ও দোলনচাপা হল,চক্রবাক ক্যাফেটোরিয়া। কবির বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের নামে এমন নামকরণ যে কারও নজর কাড়বে। কবির সাহিত্যকর্মের উপর গবেষণার জন্য রয়েছে 'ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ'। এটি জাতীয় কবির বিভিন্ন গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক সর্বোপরি তার জীবনী এবং জীবনকর্মের ওপর গবেষণা করে থাকে। প্রতিটি বিভাগেই ১০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক 'নজরুল স্ট্যাডিজ' কোর্স পড়ানো হয়। এ ছাড়া কবির জীবন ও সাহিত্যকর্মের উপর গবেষণার জন্য রয়েছে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম। সংগঠন ও অবকাঠামো : বছরের অধিকাংশ সময় বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে মুখরিত সাংস্কৃতিক আবহে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ১৫টির অধিক সক্রিয় বিভিন্ন সংগঠন। এ সবের মধ্যে রয়েছে সাংবাদকর্মীদের সংগঠন সাংবাদিক সমিতি ও প্রেস ক্লাব, গবেষণার জন্য রয়েছে রিসার্চ সোসাইটি। রয়েছে প্রথম আলো বন্ধুসভা, কালের কণ্ঠ শুভ সংঘ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, রংধনু, ডিবেটিং সোসাইটি, অরণ্য, গ্রিন ক্যাম্পাস, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ক্লাব, মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস ক্লাব, রোটারেক্ট ক্লাবসহ আরও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন। মাত্র ৫৭ একরের এই ছোট ক্যাম্পাসটিতে রয়েছে চারটি আবাসিক হল, রয়েছে পাঁচ ও দশতলা বিশিষ্ট চারটি একাডেমিক ভবন। কবির স্মৃতিঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে নজরুল ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, জয়বাংলা ভাস্কর্য, চির উন্নত মম শির স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ মিনার। পাঁচতলা বিশিষ্ট সুসজ্জিত গ্রন্থাগার, গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ, চুরুলিয়া মঞ্চসহ সুবিশাল শেখ রাসেল খেলার মাঠ। এ ছাড়া মসজিদ, টিএসসিসহ বিভিন্ন ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। উৎসবমূখর বিশ্ববিদ্যালয় : সাংস্কৃতিক মননের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাবছরই নানা উৎসবের আমেজ থাকে। নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্রজয়ন্তী, লালন স্মরণোৎসব। বিশেষ করে শীতকে বরণ করে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়াশা উৎসব ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে। এ ছাড়া নজরুল বইমেলা, চলচ্চিত্র উৎসব, পিঠা উৎসব, নাট্যোৎসবসহ নানা উৎসব লেগে থাকে বছরজুড়ে। সতেরো বছরে পদার্পণ : নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সম্প্রতি ১৬ বছর পূর্ণ করেছে কবি স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। পেয়েছে দেশবরেণ্য ছয়জন ভাইসচ্যান্সেলর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর দে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নিজ কর্ম ও ব্যক্তিত্বে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছেন তিনি। দিয়েছেন নানা প্রতিশ্রম্নতি। শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কাজ করছেন দিনরাত, ছুটিতেও অবস্থান করছেন বিশ্ববিদ্যালয়েই। শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে চালু করেছেন নতুন দুটি আবাসিক ছাত্র ও ছাত্রী, ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেছে সীমানা প্রাচীরের। সেশনজট মুক্ত করতে প্রণয়ন করেছেন অ্যাকাডেমিক কালেন্ডার। সর্বোপুরি, দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি আধুনিক স্মার্ট ক্যাম্পাস তৈরির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। মো. মিলন হোসেন শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।