মেডিকেল কলেজে ভর্তির অনুভূতি

ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাবা-মা বলেন, আমার সন্তান বড় হলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে একজন সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের এই স্বপ্নপূরণের পথ মোটেও ফুল বিছানো হয় না। কেননা, স্বপ্নপূরণের এই পথ যে বড্ড সুদীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ। সফলতার সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণের পর মেডিকেল কলেজে পা রাখতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে নামতে হয় ভর্তিযুদ্ধের তীব্র লড়াইয়ে। সে লড়াইয়ে বিজয়ী হয় অল্পসংখ্যকই। অধিকাংশকেই হেরে যেতে হয় জীবনযুদ্ধের এই অধ্যায়ে। তেমনই সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া ২০২১-২২ মেডিকেল ভর্তিযুদ্ধে বিজয়ী কিছু কৃতী সন্তানদের গল্প তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মীমিনহাজুল ইসলাম

প্রকাশ | ০৪ জুন ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পড়াশোনা হবে ভর্তি পরীক্ষাকেন্দ্রিক মো. রওশন আলী শিক্ষার্থী, শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল প্রথমেই স্মরণ করতে চাই মহান সেই সৃষ্টিকর্তাকে যার করুণায় আজ আমি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী হতে পেরেছি। হাজারো স্বপ্নের মধ্যে কোনো একটা স্বপ্নকে স্থির করা যেমন কঠিন, তার চেয়ে কঠিন সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। তাই আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই শুরু করি আমার পরিবারের সবার লালিত স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রস্তুতি। আমি যখন ছোট তখন আমার আম্মু বলত আমার এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, আরেক ছেলে ডাক্তার হবে ইনশাআলস্নাহ। অবশেষে আলস্নাহর ইচ্ছায় আমার মায়ের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। আমার বড়ভাই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার পর আলস্নাহ আমাকে মেডিকেল শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। যাই হোক ভর্তিযুদ্ধের কথায় আসি। প্রথমেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম সংক্ষিপ্ত সিলেবাসকে কেন্দ্র করে পড়ব নাকি পূর্ণ সিলেবাস? এরপর আমার শিক্ষক সুব্রত স্যারের পরামর্শে শুরু করলাম একটা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও একটা পূর্ণ সিলেবাসের অধ্যায় দিয়ে। তখন তিনি আমার স্বপ্ন পূরণের যাত্রায় এক বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। শুরুতে যতটা উদ্যম নিয়ে আমি পড়ালেখা শুরু করে ছিলাম, শেষ পর্যন্ত সেটুকু ধরে রাখতে পারিনি। কারণ নদীর স্রোত সবসময় সমান হারে প্রবাহিত হয় না। কোচিংয়ের মধ্যের সময় ছিল আমার জীবনের সব থেকে অসহায়ত্বের ও হতাশাজনক। ভর্তিযুদ্ধের সময় নিজের পরিবার ও মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া কেউ কারোর পাশে থাকে না। যদিও ভালো কিছু করলে সবাই খবর নেয়। নিজের কাছে তখন মনে হতো, আমি কি পারব নাকি হেরে যাব? অবশেষে আমাকে আলস্নাহ শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশালে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। যাই হোক, পরিশেষে অনুজদের প্রতি পরামর্শ হিসেবে একটা কথা বলব। তা হলো, তোমরা প্রথম থেকেই পড়ালেখা করবে ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। এতে ভালো ফলাফল ও চান্স দুটোই সম্ভব। তা না হলে বর্তমানে ভালো জায়গায় ভর্তির সুযোগ পাওয়াটা অনেক কঠিন। তিন মাসে পড়ে কখনো ভালো কিছু সম্ভব হয়ে ওঠে না। সবশেষে সবার মঙ্গল কামনা করছি। হতাশা কাটিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থী মালিহা ইয়াসমিন শিক্ষার্থী, খুলনা মেডিকেল কলেজ সব প্রশংসা মহান আলস্নাহতায়ালার যার অশেষ রহমতে আমার আজকের এই অর্জন। তারপর আমার এই সফলতার জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমার পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই আমি এতদূর আসতে পেরেছি। শিক্ষকদের ভেতর আমার তৎকালীন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃতু্যঞ্জয় স্যারের অনুপ্রেরণা আমাকে সব সময় পথ দেখিয়েছে। ছোট থেকেই আমার পরিবারের সবার বিশেষ করে আব্বুর ইচ্ছা ছিল আমি মেডিকেলে পড়াশোনা করব। গ্রামের হাইস্কুলগুলোতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে ভালো সুফল পাবো না ভেবে আজ থেকে আট বছর আগে গ্রাম ছেড়ে উপজেলা শহরে চলে এসেছিল আমার পরিবার। মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে এলাম। কিন্তু করোনার থাবায় হঠাৎ শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। অনলাইনে পাঠদান ততটা ফলদায়ক না হওয়ায় আস্তে আস্তে হতাশা বাড়তে লাগল। কিন্তু মহান আলস্নাহতায়ালার অনুগ্রহে এবং আমার শিক্ষক মিলু স্যার ও ঢাকা মেডিকেলের সিনিয়র আপু সুরাইয়া ইসলাম দিকনির্দেশনায় হতাশা কাটিয়ে আবারও স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করি। এইচএসসি পরীক্ষার পর কোচিংয়ের জন্য আব্বু-আম্মুকে রেখে দূরে থাকতে হয়েছে। সে সময়টা আমার জন্য কঠিন ছিল। করোনার জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এইচএসসি পরীক্ষা হলেও কোচিং শুরুর দেড়মাস পর যখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে পূর্ণ সিলেবাসেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হবে, তখন পথটা আরও কঠিন মনে হচ্ছিল। যাই হোক তারপর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। যদিও যেভাবে পরীক্ষা দেওয়ার আশা করেছিলাম, পুরোপুরি সেভাবে দিতে পারিনি। এ জন্য কিছুটা হতাশা কাজ করছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের দিন যখন আব্বুর চোখে আনন্দ অশ্রম্ন দেখেছিলাম তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষটি হয়তো আমি। আম্মু চাকরির পাশাপাশি সংসারের অন্যান্য কাজ সামলাতে গিয়ে আমার পড়াশোনার বিষয়ে তেমন খোঁজখবর রাখতে পারেননি। কিন্তু আব্বু সবসময় আমার পড়াশোনার বিষয়ে, আমার নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজ রেখেছেন। তাদের অবদান ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। যাই হোক, আসন্ন দিনগুলোতে যেন আমি নিজেকে শক্ত রেখে সব বাঁধা অতিক্রম করতে পারি এবং একজন ভালো চিকিৎসক হিসেবে সমাজের কল্যাণে কাজ করতে পারি সে জন্য সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী। পরলোকবাসী বাবার স্বপ্নকে পূরণ করেছি মোহাম্মাদ জামাল মোলস্না শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর আমার আজকের এই অর্জনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই মহান সৃষ্টিকর্তা আলস্নাহর প্রতি। তারপর আমার এই সফলতার জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমার পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই আজ আমি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। ছোট থেকেই আমার পরিবারের সবার বিশেষ করে আব্বুর ইচ্ছা ছিল আমি মেডিকেলে পড়াশোনা করব। আমার বাবার সে ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পেরেছি। কিন্তু বিধি বাম! আমার বাবা আমার এই অর্জন দেখে যেতে পারলেন না। তিনি আমার ভর্তি পরীক্ষার তিন দিন আগে আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন। ফলে, ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে পরীক্ষা দিই। আলহামদুলিলস্নাহ; আলস্নাহর ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়ার মাধ্যমে আমি আমার সদ্য পরলোকবাসী বাবার চাওয়াকে পূর্ণ করতে পেরেছি। আমার গ্রামের ভেতর আমিই প্রথম মেডিকেল কলেজে চান্স পাই। এজন্য অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিল। ফলপ্রকাশের সংবাদ শোনার পর আমার মায়ের চোখেমুখে যে আনন্দের কান্না দেখেছিলাম সেটা ছিল আমার জীবনের বড় অর্জন। মুহূর্তেই দূর হয়ে গিয়েছিল দুই বছরের কষ্ট। এরপর ভর্তি হতে যখন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে প্রথম পা দিয়েছিলাম, সেটা ছিল অন্য রকম অনুভূতি। সেই মুহূর্তই ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কেননা, স্বপ্নপূরণে যে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখন থেকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। কেননা, ডাক্তার হয়ে যে আর্তমানবতার সেবায় আমাকে নিযুক্ত হতে হবে। এই পথচলায় সবার দোয়াপ্রার্থী। বাবা-মায়ের চোখের আনন্দ অশ্রম্ন সেরা অর্জন জান্নাতুল ফেরদৌস মিম শিক্ষার্থী, পাবনা মেডিকেল কলেজ, পাবনা আমি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আলস্নাহর রহমতে পাবনা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছি। এ জন্য আমি মহান আলস্নাহতায়ালার নিকট শুকরিয়া আদায় করছি, তারপর আমার মা-বাবাকে এবং আমার শিক্ষক ডা. বাপ্পি ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সাধারণত আমরা সবাই ভাবী, ভর্তি পরীক্ষার আগের তিনমাস ভালো করে পড়াশোনা করব, কিন্তু সত্যি বলতে এই তিনমাস পড়ে কখনোই ভালো ফলাফল করা সম্ভব নয়। প্রস্তুতিটা নিতে হবে উচ্চ মাধ্যমিক থেকেই। প্রতিদিনের পড়াশোনা প্রতিদিনই শেষ করতে হবে। তার সঙ্গে সাহায্য চাইতে হবে আলস্নাহর। ফলাফল প্রকাশের দিন খুব ভয় লাগছিল, এই দিনের সময়টা যেন কাটছিল না। যখন জানতে পারলাম আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি, তখনকার সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সেই সময়ে আমার মা-বাবার চোখে যে আনন্দের অশ্রম্ন দেখে ছিলাম সেটা ছিল আমার জীবনের বড় অর্জন। মুহূর্তেই দূর হয়ে গিয়েছিল দুই বছরের কষ্ট। সবাই যখন বলে ডাক্তারের মা-বাবা তখন আমার মা-বাবার মুখে যে হাসি শোভা পায়, তা আমার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। এরপর ভর্তি হতে যখন আমি পাবনা মেডিকেল কলেজে প্রথম পা দিয়েছিলাম, সেটা ছিল অন্য রকম অনুভূতি। এই স্বপ্নপূরণে আমাকে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। আর এখন তো আরও বেশি পড়াশোনা করতে হবে। কেননা, আমি একজন আদর্শবান ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। স্বপ্নপূরণের এই পথচলায় আমি সবার দোয়াপ্রার্থী।