চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নীলগিরিতে একদিন

বেলা ১১টার পর মেঘ চোখের সামনে কুয়াশার মতো উড়তে শুরু করে সঙ্গে সঙ্গে শরীরকে অতিক্রম করার সময় মনে হবে, যেন হালকা শিরশিরে অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। সবার খুব ইচ্ছে করছিল। ইশ! হাতের মুঠোয় করে কিংবা পকেটে ভরে এক টুকরো মেঘ বন্দি করে নিয়ে যেতে পারতাম

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২২, ০০:০০

মো. মারুফ মজুমদার
কবি পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, 'এসো বন্ধু, দেখে যাও- সেই স্বর্গভূমি। পাহাড় ছুঁয়েছে আকাশ এখানে, আকাশ ছুঁয়েছে ভূমি'। পাহাড়ের বুকে বর্ষায় মেঘের পরশে প্রকৃতি হয়ে ওঠে ভীষণ কাব্যময়। নিঃসন্দেহে, মেঘের উদ্দাম নৃত্য সবাইকে মুগ্ধ করে। কখনো রোদ তো, কখনো এই বৃষ্টি। আকাশে মেঘের গর্জন, সেই সঙ্গে রংধনুর হাসিমাখা আলোক রশ্মি। বাতাসের সঙ্গে তাল, লয় আর ছন্দ মিলিয়ে প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যময় পরিবর্তনের দৃশ্যগুলো ভীষণভাবে কাছে টানে। কিছুটা সময় যান্ত্রিকতা থেকে দূরে প্রকৃতির অতি সন্নিকটে মেঘের রাজ্যে মেঘের সঙ্গে আলিঙ্গন। বলছিলাম নাঙ্গলকোট স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসএসিইউ) বার্ষিক বনভোজন বান্দরবানের মেঘের বাড়িখ্যাত নীলগিরিতে ভ্রমণের কথা। দিনটি ছিল শুক্রবার (৩ জুন)। শুরুতেই চট্টগ্রামের বিপস্নব উদ্যান থেকে ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে পূরবীর গাড়ি ছাড়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। বান্দরবান যাওয়ার রাস্তায় কমপক্ষে ১০-১২টি জায়গায় উন্নয়ন কাজ চলায় এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে আর্মি চেকপোস্টসহ আমাদের দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছিল বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড পৌঁছাতে। তারপর সেখান থেকে চান্দের গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় নীলগিরি। আমাদের ৪৫ জনের জন্য তিনটি চান্দের গাড়ি ঠিক করে দেওয়া হলো। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পিচডালা রাস্তা দিয়ে চান্দের গাড়ি করে যাওয়ার সময় বেসম্ভব সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্য অবলোকন করতে ভুল হয়নি এবং গাড়ির দূরন্ত গতির সঙ্গে বিশুদ্ধ তীব্র বাতাস আস্বাদন করা থেকেও কেউ বাদ যায়নি। চান্দের গাড়ি করে যাচ্ছি আর মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে দুর্লভ মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করছি। পথিমধ্যে, পাহাড়ি রাস্তা দুই ধারে বাহারি ধরনের পাহাড়ি ঘরবাড়ি, দোকানপাট এবং কিছু পর্যটন স্পট রয়েছে যা দর্শনার্থীদের মনোহর করার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে। প্রায় দেড় ঘণ্টার পর বহুল কাঙ্ক্ষিত নীলগিরি তথা মেঘের রাজ্যে পৌঁছালাম। তবে চান্দের গাড়িতে ভ্রমণে যে তীব্র অনুভূতি সৃষ্ট করে তা অনস্বীকার্য। তবে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষাকল্পে সতর্ক হওয়া জরুরি। নীলগিরি প্রবেশমুখে টিকেট কেটে নীলগিরি মূল স্পটে পৌঁছানোর পর মনে হবে, যেন পাহাড় ও মেঘের মাঝখানে দুই হাজার ফুট উপরে আপনার ভ্রমণে আক্ষেপ তৈরি করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবেশ পরবর্তী সবাই অনিন্দ্যসুন্দর স্পটগুলোতে সবার অসাধারণ মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে তৎপর হয়ে আছে। এরমধ্যে অ্যাসোসিয়েশনের সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে গ্রম্নপ ফটো, সিনিয়র-জুনিয়র ফটো তোলা এবং ব্যক্তিগত ছবি তোলা তো সবার আগে সম্পন্ন হয়েছে। এরপর বেলা ১১টার পর মেঘ চোখের সামনে কুয়াশার মতো উড়তে শুরু করে সঙ্গে সঙ্গে শরীরকে অতিক্রম করার সময় মনে হবে, যেন হালকা শিরশিরে অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। সবার খুব ইচ্ছে করছিল। ইশ! হাতের মুঠোয় করে কিংবা পকেটে ভরে এক টুকরো মেঘ বন্দি করে নিয়ে যেতে পারতাম। পাহাড়ের বুকে মেঘের ভেলায় সাঁতার কাটার আগ্রহ জাগাও খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন। কিন্তু, এই দুর্লভ মেঘগুলোকে শুধু চোখে দেখা এবং অনুভূতিতে করেই রাখা যায়। মজার বিষয় হচ্ছে- নীলগিরিতে আসার সময় সূয্যিমামার তপ্ত প্রভাব যেরকম পেয়েছি আসার সময় এর দ্বিগুণ বৃষ্টির সঙ্গে শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূতি যেন একসঙ্গে তিনটে ঋতুর (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত) স্বাদ জুগিয়েছে। দুপুর ঘনিয়ে বিকালের আগে দুপুরে খাবার শেষে আবার চান্দের গাড়ি করে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার সময়, চিম্বুক পাহাড়, শৈলপ্রপাত ঝর্ণার পরিভ্রমণ করা হয়। অভিজ্ঞতার থলিতে যেন নতুন মাত্রা যোগ হলো। তবে জানিয়ে রাখা ভালো, নীলগিরির সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- দিনের বেলা ওখান থেকে খালি চোখে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্র্যাডং এবং প্রাকৃতিক আশ্চর্য বগালেক তার সঙ্গে চোখ জুড়ানো পাহাড়ের সারি, পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর ও জাহাজ চলাচলের দৃশ্য দেখা যায়। পাহাড়ি এই দুহিতার দৃষ্টিনন্দন আঁকাবাঁকা সর্পিল পথচলা পর্যটককে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে বৈকি। বলা বাহুল্য, প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা নয়নাভিরাম এমন দৃশ্য স্মৃতির ফ্রেমে ধরে রাখার জন্য নীলগিরি সত্যিই অতি চমৎকার একটি জায়গা। সর্বশেষ সূয্যি মামা তার দিনান্তের পাঠ শেষে বাড়ি ফিরছে। আমরাও তার পিছু পিছু। বিকালের আবির আলো লাল পাহাড়কে রাঙিয়ে তুলেছে দ্বিগুণে। বন্ধুর পথে আমরা ফিরছি আপন নীড়ে। সেই পথের বাঁকে বাঁকে খেলা করছে রহস্য রোমাঞ্চের অদ্ভুত জগৎ। যেন আকাশের তারাগুলো চোখের ইশারায় কথা বলছে। শিয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ, ঝিঁ ঝিঁর ডাক এবং জোনাকিরা আলো ছড়াচ্ছে। গাড়ি ছুটছে যেন শাঁ শাঁ শব্দে। যথারীতি বান্দরবান বাস টার্মিনালে পৌঁছে সন্ধ্যার দিকে বাস ছাড়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য এবং বাস ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটি কাটে তখনই যখন র?্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয় বিনিময়ে পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং প্রচুর গান-বাজনা, হৈ-হুলেস্নাড় শেষে এনএসএসিইউর বর্তমান সভাপতি মো. মাজেদুল হাসানের সমাপনী বক্তব্যে আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি টানেন। তিনি বলেন, এই ভ্রমণ যেমন শিক্ষণীয় তেমনি অ্যাসোসিয়েশনের প্রত্যেক সদস্যদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তালে তালমিলিয়ে সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম বলেন, এ আয়োজন প্রতিবছর করা হবে। সবার সম্মিলিত করতালির সমর্থনসূচক শব্দটি তখন আর বিদ্ঘুটে লাগেনি। অসাধারণ এক সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়ে আপন নীড়ে ফিরল সবাই। পুঞ্জীভূত হলো নতুন আরেক অভিজ্ঞতা।