'কাঙ্গাল কুঠির' কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ি

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ম মো. মুসা আহমেদ
প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার কুষ্টিয়ার শিলাইদহে তার নিজ বাড়িতে ১৮৭৩ সালে 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পত্রিকা মুদ্রণের মাধ্যমে 'এম এন প্রেস'-এর যাত্রা শুরু করেন। এটিই ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রথম মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক এই স্থানটি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ২১ জুলাই সকাল ৯টায় আমি, আজাদ ভাই ও ওয়ালিউলস্নাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে একত্রিত হয়ে ক্যাম্পাস থেকে ছেড়ে যাওয়া কুষ্টিয়াগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর নির্ধারিত বাস চলে এলে আমাদের অনেকটা প্রতিযোগিতা করে আসন দখল করতে হয়। সকালের মিষ্টি রোদ আর হিমেল হাওয়া উপভোগ করতে করতে পৌঁছে যাই কুষ্টিয়ার চৌড়হাস মোড়ে। সেখান থেকে অটোতে কুমারখালি বাস স্ট্যান্ড এবং বাস স্ট্যান্ড থেকে একটা ভ্যান নিয়ে সোজা চলে যাই কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরে। ১২ শতক জায়গার উপর অবস্থিত লাল রঙা স্থাপনাটি পৌঁছানো মাত্রই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ভ্যান থেকে নেমে ফটকের পাশে অবস্থিত কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে জাদুঘর এলাকায় প্রবেশ করলাম। প্রবেশপথেই কাঙ্গাল হরিনাথের ৭.৩ ফিট উচ্চতার স্মৃতি-ভাস্কর্য আমাদের স্বাগত জানাল। নির্ভীক চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতি-ভাস্কর্য স্মরণ করিয়ে দিল; কীভাবে লেখনীর মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা যায়, কীভাবে শোষকের লাগাম টেনে ধরতে হয়। মূলত কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার তার লেখনীর মাধ্যমে প্রজাদের উপর জমিদার ও নিলকদের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতেন। স্মৃতি-ভাস্কর্যটির পাশেই রয়েছে দুই তলা বিশিষ্ট লাল ইট আর মোজাইক টাইলসের কারুকাজে নির্মিত একটি ভবন; যার নিচ তলাতে সম্মেলন কক্ষ, দ্বিতীয় তলায় মূল জাদুঘর এবং একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল তৎকালীন সময়ের পান্ডুলিপির অংশবিশেষ, লেখা কবিতা, পত্রিকা, ছবি ও মুদ্রণের জন্য ব্যবহৃত কাঠের বস্নকসহ নানা যন্ত্রপাতি। জাদুঘরে থাকা প্রত্যেকটা বস্তু-ই সে সময়ের গ্রামীণ সাংবাদিকতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তবে 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' মুদ্রণের জন্য ব্যবহৃত মথুরনাথ মুদ্রণযন্ত্রটি জাদুঘরে না থাকায় আমাদের যেতে হলো 'কাঙ্গাল কুঠির' তথা কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ি। সেখানে পৌঁছাতেই টিনের চালা ও ইটের দেয়াল বিশিষ্ট একটি ঘর সামনে এলো। যার দরজার উপরে লেখা ছিল 'এমএন প্রেস'। বাড়িতে কেউ আছে কিনা জানতে চাইলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন দেবাশীষ মজুমদার, যিনি কাঙ্গাল হরিনাথের ৬তম বংশধর। দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতায় জানতে পারলাম অনেক কিছু। তিনি এটাও জানালেন, একটা সময় এই ঘরটাতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন লালন শাহ, মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও দীনেন্দ্রনাথ রায়ের মতো ব্যক্তিরা। আলাপচারিতা শেষে আধো ভাঙা ঘরটিতে প্রবেশের পর একটা কোণে বিখ্যাত মথুরনাথ মুদ্রণযন্ত্রটি দেখতে পেলাম। এছাড়া মুদ্রণের জন্য ব্যবহৃত আরও কিছু যন্ত্রাংশ ও পান্ডুলিপি চোখে পড়ল। ঐতিহাসিক মদ্রণযন্ত্রটি স্পর্শ করে দেখলাম। এ যেন এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন এবং সাংবাদিকতার ধারা সূচনায় এর অবদান ছিল ব্যাপক। কাঙ্গাল কুঠিরের এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে আমরা বিদায় নিই; ফিরে আসি নীড়ে।