জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শীতে কুয়াকাটায়

প্রকাশ | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

নাফিউর রহমান ইমন
সকালে ঘুম ভাঙল কিছুটা বিরক্তি নিয়ে। সাড়ে ৮টায় ক্লাস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তৈরি হয়ে নিলাম। সকালের নাস্তা শেষবারের মতো কবে করেছি মনে পড়ছে না। অঁাকাবঁাকা পথ দিয়ে ক্লাসের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমি, সুমন, শাহাদাৎ আর শাহিন। পেছন থেকে শুভো আর মহান ডেকে উঠল। ফিরে তাকাতেই শুভো বলল, ‘প্লানটা কি সবার মনে আছে?’ গত কয়েক দিন ধরেই ট্যুরের ব্যাপারে কথা হচ্ছিল সবার সঙ্গে। সবার মতামত নিয়ে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আজ ক্লাসের ভীষণ চাপ। সকাল সাড়ে ৮টা, সাড়ে ১০টা, সাড়ে ১১টা এবং সবশেষে আড়াইটায় ক্লাস। ম্যাম ক্লাস নিলে বিকেল ৪টা পযর্ন্ত। সময়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম। ৫টায় ক্যাম্পাসের বাস ছেড়ে যাবে ঢাকার উদ্দেশে। তড়িঘড়ি করে হলে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। শুরু হলো কাক্সিক্ষত যাত্রা। গুলিস্তান গিয়ে কিছু কেনাকাটা করে সদরঘাট পৌঁছাতে প্রায় রাত ৮টা ছাপ্পান্ন বেজে গেল। রাত ৯টার দিকে শেষ লঞ্চটি ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশে। টিকেট কেটে লঞ্চে উঠলাম। সুন্দরবন-১১। পঁাচ তলা বিশিষ্ট বিশালাকার এ লঞ্চে আছে লিফটের সুবিধা। আমরা গেলাম সবার উপরের তলায়। যেখান থেকে আকাশ, বাতাস, নদী ও শহরের লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আলো দেখা যায়। মুক্ত বিহঙ্গের মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন উড়ছি নিকষ কালো অন্ধকারে তারাদের মাঝে। মাঝে একফালি চঁাদের আলোয় পদ্মার ঢেউগুলো চিকচিক করছে। লোকালয় দেখা যায় না। দূরে কয়েকটা লঞ্চ, ও মাঝারি সাইজের নৌকা ভেসে থাকতে দেখলাম। লঞ্চ ছুটে চলছে বরিশালের উদ্দেশে। ভোর ৪টার দিকে লঞ্চ বরিশালে পেঁৗছল। সেখান থেকে যেতে হবে রুপাতলি। প্রতিজন ২০ টাকা ভাড়ায় লেগুনায় করে গেলাম রুপাতলি বাসস্ট্যান্ড। গাড়িতে কুয়াকাটার ভাড়া জনপ্রতি দুশো চল্লিশ টাকা করে। গাড়ি চলছে কুয়াকাটার উদ্দেশে। সমুদ্র সৈকতে গিয়ে পেঁৗছাতে প্রায় ১০টা বেজে গেল। দূর থেকেই সাগরের গজর্ন শুনতে পেলাম। আহা! এ যে সুখ, এ যে মায়া,বহুদিনের জমানো তৃষ্ণাতর্ হৃদয়ের আকুলতা। কয়েক মিনিটের জন্য মনে হলো, ‘আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম’। বহুবার সাগরের সৌন্দযের্র কথা শুনেছি, চোখে দেখা হয়নি। ১৮ কিলোমিটার দৈঘের্্যর এই সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের অন্যতম পযর্টন কেন্দ্র। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নে কুয়াকাটা অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূযোর্দয় ও সূযার্স্ত দুটোই দেখা যায়। কুয়াকাটা নামকরণের পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, আঠারো শতকে আরাকানরা মুঘল শাসকদের দ্বারা বামার্ (বতর্মান মিয়ানমার) বিতাড়িত হয়। তারা ছোট ছোট নৌকায় করে এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তখনকার সময়ে এখানে সুপেয় জলের অভাব ছিল তাই তারা এখানে কয়েকটি ক‚প খনন করে। কুয়াকাটার ‘কুয়া’ শব্দটি ওই ‘ক‚প’ থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম কুয়াকাটা। যাইহোক, হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে সমুদ্রে নামলাম। সে কি ঢেউ! সে কি উচ্ছ¡াস! মনে হলো হারিয়ে যেতে আর বাধা নেই। এখানে ভয় আছে, উদ্বেগ আছে, উল্লাস আছে, আনন্দ আছে, অজানাকে জানার আকুতি আছে। ভিজে ভিজে সন্ধ্যার ঠিক আগে আগেই চলে আসলাম। সূযার্স্ত দেখা হলো না? কিন্তু পরের দিনের ভ্রমণের জন্য বাইক ঠিক করে রাখলাম। পরদিন সূযোর্দয়ের আগেই বাইকে করে চলে গেলাম স্পটে। নীরব প্রকৃতি যেন থেমে থেমে জানান দিচ্ছে সাগরের অস্তিত্ব। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে ভেজা বালুর চিকচিকে কনার ওপরে। পূবর্ দিগন্ত আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠল। সূযর্ উঠল রক্তিম আভা নিয়ে। সলিল সমুদ্রের বুক চিরে। বেরিয়ে এল সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটির মতো করে। আশপাশে তাকালাম। সবাই দেখছে। কেউ আবার ছবি তুলছে। আলো বাড়তে থাকল। রৌদ্র তাপে জলগুলো কেমন ছলছল করছে! বাইক আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমাদের যেতে হবে পরের স্পটে। লাল কঁাকড়ার দ্বীপ। হাজারো কঁাকড়া হেঁটে বেড়ায় এখানে। কাছে গেলেই গতের্ ঢুকে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে একটাকে ধরলাম। ছবি তুললাম। মাঝে মাঝে অস্থায়ী জেলেদের পল্লী চোখে পড়ল। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত গঙ্গামতির (গজমতির) জঙ্গল দেখলাম। সময় যেন বঁাধ মানছে না। দুপুর গড়িয়েছে। দেখার আরো অনেক কিছুই আছে। এখানে অনেক প্রতœতাত্তি¡ক নিদশর্ন এবং আদিবাসীদের বসতি রয়েছে। কেরানীপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, সীমা বৌদ্ধ মন্দির, ফাতরার চর, আমখোলাপাড়া, শুঁটকি পল্লী, আলীপুর বন্দর উল্লেখযোগ্য। এখানে এলে রাখাইন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পকের্ বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। তাই প্রথমে গেলাম মিস্ত্রিপাড়ায়। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে আট কিলোমিটার পূবের্ এর অবস্থান। এখানে রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূতির্। তারপর কেরানীপাড়ার রাখাইন পল্লী। পল্লীর শুরুতেই রয়েছে ‘কুয়া’। কুয়ার সামনেই রয়েছে প্রাচীন সীমা বৌদ্ধ মন্দির। এতে প্রায় সঁাইত্রিশ মন ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূতির্ রয়েছে। এসব মন্দিরে এখন গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান করা হয়। আলীপুর বন্দরে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় মৎস্য ব্যবসা কেন্দ্র। যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে। শুঁটকি পল্লীতে যাওয়া হয়নি সময় সল্পতার কারণে। সময় যে বড় নিষ্ঠুর। দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলের লাল আলো ক্রমশই কমে আসছে। ফিরতে হবে বহুদূরে। প্রায় ৩৮০ কিলোমিটার পথ। সকাল বেলায়ই সাকুরা পরিবহনের বাস ঠিক করে গিয়েছিলাম। রাত ৯টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করে রাতের খাবার খেয়ে বাসে উঠলাম। বাস চলছে অনেকগুলো স্মৃতি নিয়ে। উত্তরের হিম হিম বাতাস গায়ে লাগছে। এ বাতাস শিহরণ জাগায়। শিহরণ জাগায় মনে। ইস! পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেন? বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই দেখার আছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির রানি সাগরকন্যা কুয়াকাটা।