রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

লাল পাহাড়ের দেশ

প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

নাজমুল মৃধা
অঁাকাবঁাকা রাস্তার দুপাশে উঁচুনিচু টিলা আর মাঝেমধ্যে দুএকটি ধান ক্ষেত। এ যেন প্রকৃতির এক নৈসগির্ক সৌন্দযর্। রাস্তার দুপাশে আকাশচুম্বী গাছের সারি, চোখ জুড়ানো পাহাড় যেন সবুজের কাপের্ট বিছিয়ে রেখেছে। আমাদের বাস এগিয়ে চলছে, এগিয়ে চলছে আমাদের উৎসুক দৃষ্টি। বাসের জানালাগুলো একঝঁাক তরুণের প্রকৃতির নিমর্ল বাতাস আর জীবনের ছন্দ দিতে প্রকৃতির অপার সৌন্দযের্ক দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। হেমন্তের সকালে শিশিরভেজা ঘাসে তখনো সূযের্র আলো এসে পড়েনি। কুয়াশার চাদরে তখনো ঢেকে থাকা ছোট ছোট পাহাড়গুলোর আকষর্ণ উৎসুক দশর্কদের ঘুমাচ্ছন্ন ভাবগুলোকে এক নিমিষেই দূর করে দিয়েছে। বলছিলাম, শেরপুর জেলার দশর্নীয় স্থান মধুটিলা ইকোপাকর্ এবং গজনী অবকাশ কেন্দ্র ভ্রমণের গল্প। সারি সারি রাবার গাছের সমারোহ, ফলজ শাল, গজারি ও সেগুন বনের বিন্যাস অনায়েসেই প্রকৃতি প্রেমীদের করে তুলতে পারে উদ্বেল। পাহাড়ি ঝরনার স্বচ্ছ জল হৃদয়ে তুলবে আনন্দের হিন্দোল। শুধু যে পাহাড়, বনাঞ্চল এবং ঝরনা রয়েছে তা নয়, এতসব প্রকৃতির মধ্যেও রয়েছে সৌন্দযের্র কৃত্রিম বাহার। এ এলাকাটি মূলত শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। আমরা প্রথমে যাই বারমারী এলাকার খ্রিস্টান ধমীর্য় উপসানলয়ে। তারপর সেখান থেকে একটু দূরে আমাদের কাক্সিক্ষত মধুটিলা ইকোপাকের্ এবং গজনী অবকাশ কেন্দ্রে অবস্থান করি। আগে অনেক শুনেছি ওয়াচ টাওয়ারের গল্প, এবার উপরে উঠে দেখার পালা। উপরে উঠে পাহাড়ের চ‚ড়া দেখার স্বাদ আমাদের তর সইছিল না। ওয়াচ টাওয়ারটির উচ্চতা প্রায় ৬৪ ফুট। যতই উপরে উঠেছি প্রকৃতি যেন তাদের কোলে তুলে নিচ্ছিল আমাদের। মনে হচ্ছিল সবুজ পাহাড়ের প্রকৃতি যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে উপভোগ করার জন্য। জনবসতিগুলো উপরে উঠতেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল প্রকৃতির বিশাল সমুদ্রে আমরা সবাই সঁাতার কাটছি। দূর থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের স্পশর্ আর অনুভ‚তি আমাদের শিহরিত করে তুলছিল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে ঘন শালবন, সেগুন, মেহগনি, মহুয়া আরো নাম না জানা অনেক বৃক্ষ। যখন আমরা ওয়াচ টাওয়ারটির চ‚ড়ায় উঠলাম তখন মনে আনন্দের হিল্লোল বইছিল। এমনিতেই সাহিত্যের ছাত্র আমরা। প্রকৃতির এমন দৃশ্য তরুণ মনে এনে দিচ্ছিল বাসন্তী রং। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পাগল হওয়ার দশা আমাদের। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল আমরা আকাশে মেঘের ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছি। পাহাড়ের ফঁাকে ফঁাকে ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর ধানক্ষেত। উপর থেকে মনে হচ্ছিল কে যেন সবুজ আর টিয়া রঙের গালিচা পেতে রেখেছে। কখনো কখনো ওয়াচ টাওয়ারের বটগাছের তলায় হেলান দিয়ে দশর্নাথীর্রা ছবি তুলছিল। বটগাছের পাশের চমৎকার একটি লেক বয়ে চলেছে। তিনটি ময়ূরপঙ্খী ভাসছে লেকটিতে। এ যেন পাবর্ত্য রাজাদের নৌবিহারের দৃশ্য। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের চ‚ড়ায় বৃক্ষের ফঁাকে ফঁাকে দঁাড়িয়ে আছে ডায়নোসর, জিরাফ এবং হাতির কৃত্রিম প্রতিকৃতিগুলো। দূর থেকে যে কেউ প্রথমে অঁাতকে উঠতে পারেন। এমন অনেক অঁাতকানোর মতো দৃশ্য আছে এ পাহাড়ে। বৃহত্তম ময়মনসিংহের এ জেলাটিকে ঘিরে রেখেছে পুরনো ব্রহ্মপুত্র আর পাহাড়ি নদী ভোগাই, মহারশি, মারিজি, সোমেশ্বর এবং মৃগী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের চতুথর্ বষের্র শিক্ষাথীর্রা দুইটি বাস নিয়ে বাষির্ক শিক্ষাসফরে রওয়ানা হই শেরপুরে। আমাদের ৮৫ জন শিক্ষাথীর্র সঙ্গে ছিলেন বিভাগের দুজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক গৌতম দত্ত স্যার এবং ড. সুমাইয়া খানম ম্যাম। গজনী পাহাড়টি ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবতীর্ কাংশ ইউনিয়নে উপস্থিত। রাস্তার পাশেই বিজিবির ক্যাম্প, সদস্যরা সীমান্ত পাহাড়া দিচ্ছিল। এই এলাকার আরেকটি নাম আছে যেটি ‘গারো পাহাড়’ নামে অধিক পরিচিত। আশপাশের বাড়িঘরগুলোই বলে দেয় এখানে আদিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশের বসবাস। হাজং, গারো, এবং কোচরাই এ অঞ্চলের প্রধান আদিবাসী। গজনী অবকাশ কেন্দ্রেই আমাদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করেন নালিতাবাড়ী উপজেলার নাজমুল সিদ্দিকী সরকারি কলেজের অধ্যাপক জিন্নাহ ভাই। এ ছাড়া আমাদের জন্য সরকারি রেস্ট হাউসটিতে বিশ্রামের ব্যবস্থাও করেন। তিনি ছিলেন রাবির বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র। গজনী অবকাশ কেন্দ্রটিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে কিছু দশর্নীয় বিনোদন কেন্দ্র। প্রকৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির একটা মেলবন্ধন ঘটেছে স্থানটিতে। এখানে রয়েছে মৎসকন্যার ভাস্কযর্। মিষ্টি হাসিতে যেন পযর্টকদের স্বাদরে গ্রহণ করছে সে। কিছুক্ষণ পর গেলাম চিত্রা হরিণের মিনি চিড়িয়াখানায়। আমরা স্থানটির পদ্মসিঁড়িতে কিছুক্ষণ হাটি। গজারি বন আর সবুজের নিবিড় সংমিশ্রণে যে কেউ হয়ে উঠবে কবি! এ যেন কবিতামালার বাগান! সবশেষ জিন্নাহ ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন লেকের মাঝখানে একটি দ্বীপে। যেটির নাম ‘লেকভিউ পেন্টাগন’। দ্বীপে যাওয়ার জন্য আছে স্টিলের একটি সেতু। এ ছাড়া রয়েছে কৃত্রিম সুরঙ্গ পথ ‘পাতালপুরী’। ক্রিসেন্ট লেকের মাঝখানে আছে কৃত্রিম ঝরনা ‘নিঝর্র’। আবার পশ্চিম পাহাড়ে আছে বণির্ল সেতু ‘রংধনু’। সব স্থানেই আমরা বন্ধুরা মিলে বিভিন্নভাবে ছবি তুলি। এর আগে দুপুরে আমরা খাবার খাই। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পশ্চিম আকাশের সূযর্ হলদে থেকে রক্তবণর্ আকার ধারণ করতে থাকে। সেও বিদায় নিতে থাকে। আর আমাদের দেয় বিদায়ের বাতার্। আমরা সবাই আমাদের বাসের কাছে জড়ো হতে থাকি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসে, সন্ধ্যা থেকে অন্ধকার। সুনসান নীরবতা বিরাজ করে স্থানটিতে। সম্ভবত আমরাই দিনের সবের্শষ পযর্টক হিসেবে তখন ছিলাম জায়গাটিতে। জোনাকিরা দলে দলে বনের আড়াল থেকে বের হয়ে আসছিল। কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলছিলেন, আপনারা এখনো স্থান ত্যাগ করেননি! বনাঞ্চল থেকে যে কোনো সময় হাতিসহ বন্যপ্রাণী আক্রমণ করতে পারে! আমরা বাসে উঠে ড্রাইভারকে বললাম এবার চলুন। বনের আড়াল থেকে কয়েকটি শেয়াল ডাকছিল, আমরা কিন্তু থামিনিÑ রওয়ানা হই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।