বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন যখন পশু বিজ্ঞানী

রায়হান আবিদ
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ভৌগোলিক দিক থেকে কৃষিনির্ভর এ দেশের অর্থনীতি কৃষিকে নির্ভর করেই টিকে আছে। যুগের পর যুগ কৃষি অনুশীলনের ফলেই আজ কৃষিপ্রযুক্তি উন্নতির এত প্রমাণ মেলে। অর্থাৎ কৃষি অতীত থেকেই ঊর্ধ্বমান বিকাশে চলমান। সেই কৃষির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রাণিজ উৎপাদন।

কৃষিশিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পথিকৃৎ হিসেবে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ষাটোর্ধ্ব এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশে কৃষিশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। ময়মনসিংহ শহর হতে চার কিলোমিটার দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র ননদের তীরঘেঁষে ১ হাজার ২০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ পর্যন্ত স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডিসহ উত্তীর্ণ মোট গ্র্যাজুয়েট সংখ্যা ৫১,২৪৪ জন।

ছয়টি অনুষদ ও ৪৬টি বিভাগ নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তারই একটি অনুষদ 'পশু পালন' অনুষদ। বর্তমান কৃষির বিকাশে দেশে সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুপালন বিষয়টি পড়ানো হয়। আর এই পশুপালন বিষয়ে গ্র্যাজুয়েটকারীদের বলা হয় পশু বিজ্ঞানী। আমরা অনেকেই মনে করি পশুপালন মানে শুধুই পশুপালন করা। সাধারণ অর্থে সঠিক মনে হলেও প্রকৃত অর্থে পশুপালন হচ্ছে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পশুকে খাওয়ানো, প্রজনন করানো, যত্ন নেওয়া, তত্ত্বাবধায়ন ও সংরক্ষণ, বাজার জাত করানোসহ দেশের দুধ, ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণ।

বাংলাদেশে পশু বিজ্ঞানীর চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুপালন অনুষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই অনুষদে সর্ব মোট পাঁচটি বিভাগ রয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে পশুপালন গ্র্যাজুয়েটদের অবদান চোখে পড়ার মতো। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শিল্পক্ষেত্র পোল্ট্রি বিভাগে কাজ করে যাচ্ছে তারা। পশু উৎপাদন, পোল্ট্রির প্রসার তথা দারিদ্র্যবিমোচনে এই গ্র্যাজুয়েটরা অনবদ্য ভূমিকা রাখছে।

যা পড়ানো হয় এই অনুষদে

ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের আওতাধীন একটি ডেইরি খামার রয়েছে। এই খামারের মূল উদ্দেশ্য হলো স্নাতক ছাত্রদের ব্যবহারিক ক্লাস এবং স্নাতকোত্তর ছাত্র ও শিক্ষকদের গবেষণা কাজের সুবিধা প্রদান করা। এটি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের জন্য সুবিধা প্রদান করে থাকে। বর্তমানে খামারে বিভিন্ন জাত ও বয়সের প্রায় তিন শতাধিক গরু ও মহিষ রয়েছে।

পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধীনে একটি পোল্ট্রি খামার রয়েছে। প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, গবেষণা এবং সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে কাজ করছে। এই খামারের মূল উদ্দেশ্য হলো অনুরূপ সুবিধা প্রদান করা যা ডেইরি ফার্মের ধারায় বলা হয়েছে। খামার ব্যবস্থাপনা কৃষক এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারীদের জন্য সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ এবং সম্প্রসারণ কর্মসূচিরও ব্যবস্থা করে। পোল্ট্রি ফার্মে বিভিন্ন জাতের কোয়েল, মুরগি, হাঁস ও কবুতর রাখা হয়েছে।

পশু বিজ্ঞান বিভাগ ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়ার খামার দ্বারা পরিচালনা করে। দুগ্ধ খামারের ক্ষেত্রেও মূল উদ্দেশ্য একই। প্রায় ৭৫টি ভেড়া এবং ৫০টি ছাগলের পাল রয়েছে। ছাগল ও ভেড়া পালনের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রদর্শন এবং গবেষণার জন্য পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবহারিক প্রদর্শনের জন্য অল্প সংখ্যক ঘোড়াও রয়েছে।

কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। এটি কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে পশুপালনের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া ও মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা পরিচালনা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত। এটি গ্রামীণ জনগণকে তাদের গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য তার পরিষেবাও প্রসারিত করে। এই কেন্দ্রে ছাগল, ভেড়া, গরুর বিভিন্ন জাতকে কৃত্রিমভাবে প্রজনন করা হয়।

পশু পুষ্টি ফিল্ড স্টেশনটি বড় এবং ছোট গবাদিপশু, ছোট প্রাণী এবং হাঁস-মুরগির জন্য ফিল্ড ল্যাবরেটরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রাণী পুষ্টি ফিল্ড ল্যাবরেটরি প্রাণী পুষ্টি বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। এই বিভাগের প্রধান উদ্দেশ্য হলো পশুর পুষ্টি, ফিড শিল্প এবং ফিডস্টাফের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পশুপালনের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনা করা। এটি পশুখাদ্য উৎপাদন, পশু পুষ্টি এবং অগবাদি পশুর পুষ্টি ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর গবেষণা পরিচালনার জন্য গবেষণা কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

চাকরির ক্ষেত্র

কৃষির বিকাশ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ গ্র্যাজুয়েটরা দেশের বিভিন্ন কৃষি সেক্টরগুলোতে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ও দেশের বাইরে শিক্ষকতার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের মাধ্যমে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন উপজেলার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রাণী উন্নয়ন কর্মকর্তা, হাঁস-মুরগি উন্নয়ন কর্মকর্তা অথবা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিতে পারেন। বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় ক্যাডারে কিউরেটর আর নন-ক্যাডারে জু্য অফিসার হিসেবে চাকরির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে পশুপালন গ্র্যাজুয়েটরা। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিভিন্ন ফার্ম ও গবেষণাকেন্দ্রেও কাজ করে থাকে। তাছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা, সাভারের বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় প্রজননকেন্দ্র ও দুগ্ধ খামার, সিলেটের ছাগল প্রজননকেন্দ্র, বাগেরহাটের মহিষ প্রজননকেন্দ্র, কক্সবাজারে হরিণ প্রজননকেন্দ্র, বিভিন্ন জেলায় বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্র এবং বেশ কয়েকটি জায়গায় কুমির প্রজননকেন্দ্রে পশুপালন গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি করছে। এ ছাড়া প্রাণী বিজ্ঞানী, প্রাণী আচরণ বিশেষজ্ঞ, খামার পরিচালক, পশুসম্পত্তি বা লাইভস্টক ব্যবস্থাপক, কৃষিব্যবসা পরিচালক, ভ্রূণ প্রতিস্থাপক ও কৃত্তিম গর্ভধারণ বিশেষজ্ঞ, জীব গবেষক, নতুন জাত উপস্থাপক, ফেডারাল মিট (মাংস) পরিদর্শক, খাদ্য পরিদর্শক, ল্যাবরেটরি পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক পরামর্শদাতা, মার্কেটিং ম্যানেজার, পোল্ট্রি প্রজনন বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি চাকরির ক্ষেত্র রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে