প্রকৃতি কন্যার দেশে আমরা

প্রকাশ | ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আর এম রিফাত
বছরজুড়ে থাকে যার যার পেশা বা ব্যক্তিগত কাজের কর্মব্যস্ততা। কারও কারও নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়। এভাবেই কাটে সবার সময়। যখন কর্মব্যস্ত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ভ্রমণের কথা শোনে তখন তাদের মনে ভিন্নরকম অনুভূতি কাজ করে। তেমনি যখন শুনতে পেল শীতকালে ছুটির মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি টু্যরের আয়োজন করছে। সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা এ কথা শুনে আনন্দে উৎফুলস্ন হয়ে ওঠে। প্রতিবছরই স্বল্প পরিসরে হলেও টু্যরের আয়োজন করে থাকে তারা। করোনাকালীন ছুটির পর ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি সংবাদ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা টু্যরের আয়োজন করতে পারেনি। হঠাৎই আয়োজনের কথা শুনে আচমকা হয়ে যায় তারা। পরিকল্পনা হলো ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ টু্যর হবে। বেছে নেওয়া হলো বাংলাদেশের প্রকৃতিকন্যা সিলেট বিভাগকে। সিলেটের নাম শুনতেই যেন প্রকৃতির প্রতি অতি আবেগ ও ভালোবাসা বেড়ে এলো। মন মানছেনা ২৭ আসতে এখনো সাত দিন দেরি। এদিকে কর্মতৎপরতার ফলে হঠাৎ ২৭ তারিখ, সেই আবেগ মাখানো মুহূর্তটি উপস্থিত হলো। সবাই যার যার মতো ব্যাগ গুছিয়ে ২টার ভিতরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামের সামনে এসে হাজির। এসে দেখে তাদের জন্য বাস রেডি। ৩টা পাঁচ বাজতেই যাত্রা শুরু হলো। সবার ভিতরে উৎফুলস্নতা কাজ করছে। চারদিকের প্রাকৃতিক রূপ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কারও কারও চোখে ঘুম ঘুম ভাব এসে গেছে, কেউ কেউ বাসের সিটের সঙ্গে মাথা এলিয়ে দিচ্ছে। এই সময়ে একজন হুট করে বলে উঠল আমরা এখন পদ্মা সেতুর খুব কাছে। সবারই আগ্রহের জায়গা পদ্মা সেতু নিজ চোখে দেখার। মোবাইল বের করে সবাই জানালার পাশঘেঁষে সেতুর স্মৃতি মোবাইলে রেখে দিচ্ছে। ছবি ভিডিও করতে করতে হঠাৎ সেতু পার হয়ে গেল। শুরু হলো আড্ডা গানের আসর কেউ অভিনয় করছে কেউ বা গান গাইছে কেউ বা উপভোগ করছে আবার অনেকেই মোবাইলে বুঁদ হয়ে আছে, কেউ আবার চোখ মেলে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। এরই মধ্যে চলে এলাম ঢাকায়। ভ্রমণের আগেই কথা দিয়েছেন বণিক বার্তার সিনিয়র রিপোর্টার ও সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি ইমামুল হাসান আদনান ভাই সবাইকে রাতের খাবার খাওয়াবেন। খাবার গ্রহণ করে পুরাতন নতুনের মিলনমেলা শেষে বাস চলছে সিলেটের উদ্দেশে। চলছে বাস চলছে ঘুমের আসর। চোখ মেলতেই আমরা ২৮ তারিখ ভোরে গন্তব্যে এসে গেলাম। উঠলাম সিলেট শহরে পস্নাজা হোটেলে। ফ্রেস হয়ে সকালের নাশতা করেই বাস চলছে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরের দেশে। ঘণ্টা খানেক পরেই এসে গেলাম সেখানে। সাদাপাথরের মধ্যে প্রবেশ করতেই অসম্ভব সৌন্দর্যের দেখা পেলাম। ঝর্ণা বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি, এই পানি পাথরের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাশেই ভারতের সীমানার ওপাশে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে যেন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। পানির শনশন শব্দে হৃদয়ের মধ্যে স্পন্দন তৈরি হচ্ছে। ডিএসএলআর ও মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ছবি উঠাতে। জলকেলি করছে অনেকেই, এভাবে সবাই প্রকৃতির এই সৌন্দর্য অবলোকন করছে। নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করা শেষে চলে এলাম সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম রাতারগুলের মিঠাপানির জলাবনে। পৃথিবীতে মিঠাপানির যে ২২টি মাত্র জলাবন আছে, 'রাতারগুল জলাবন' তার মধ্যে অন্যতম। মিঠা পানির এই জলাবন দেখতে হাজার হাজার পর্যটকরা এখানে আসে। পর্যটকদের মাতিয়ে জলাবন দেখানোর পাশাপাশি গানে গানে পর্যটকদের আনন্দে মাতিয়ে রাখে এখানের বুট নৌকার মাঝিরা। অধিকাংশ নৌকাচালকই অল্প বয়সের। তাদের অসাধারণ কণ্ঠে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার গানগুলো পরিবেশন করে শোনান তারা। নৌকার বাইচে বাইচে মাঝিদের কণ্ঠে রাতালগুল মুখর হয়ে থাকে সবসময়। গানে গানে উপভোগ করে রাতারগুল জলাবনে আসা দর্শনার্থীরা। জলাবন দেখা শেষ হলে এসে পড়লাম সিলেট শহরে। চলে গেলাম হযরত শাহজালাল রহমাতুলস্নাহির মাজার শরিফ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। ঘোরাঘুরি শেষ হলে রাতের খাবার শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমের দেশে। ঘুম ভাঙতেই ২৯ তারিখ। ফ্রেস ও সকালের নাশতা করে খুব ভোরে সবাই জাফলংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলাম। একটা কথা না বললেই নয় সকালের নাশতাটি ছিল বিখ্যাত পানশী হোটেলের খিচুড়ি। খুবই মজাদার। খিচুড়ি গুণগান সবাই গাইল। আবার গান ও আড্ডায় মুখরিত বাস, চলছে বাস ডান পাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ভারতের ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড় দেখতে দেখতে জাফলংয়ে এসে পড়লাম। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে আকর্ষণীয় করে তুলেছে আমাদের ভ্রমণপিপাসু হৃদয়কেও। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে স্তরে স্তরে সাজানো সবুজ গাছপালা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ এবং ডাউকি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবিরাম প্রবহমান জলপ্রপাত দেখলেই মন ভরে যায়। মনে হয় জাফলংয়ের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিয়েছে। সময় শেষ হতেই আবার বাস চলছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চা-বাগানের উদ্দেশে। দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর এখানে আসি। প্রথম স্পট ছিল লাওয়াছড়ায় সেখানের পরিবেশ উপভোগ শেষেই এসে পড়লাম চা-বাগান। বাস থেকে নেমেই সবাই ভোঁ দৌড়ে পাহাড়জুড়ে লাগানো চা-বাগান ঘুরে দেখছে। সন্ধ্যা হয়ে আসার পরও আনন্দের সঙ্গে মুহূর্তটি কেটেছে। এদিকে রাত হয়ে গেল কিন্তু এখনো চা খাওয়া হলো না। শ্রীমঙ্গলে এলাম চা খাবো না এইটা কথা। চলে এলাম চা খেতে, এইরকম স্বাদের চা কখনো খাওয়া হয়নি। একদিকে চলছে চা উৎসব অন্যদিকে চায়ের প্যাকেট কেনাকাটা। চা খাওয়া শেষে উপভোগ করে নিলাম পাহাড়ি আনারস। এদিকে সময় হয়ে এলো, চলে এলাম সিলেট শহরে। রাত কাটিয়ে ৩০ তারিখ ভোরে হঠাৎ পরিকল্পনায় বাস ছুটে চলল কুমিলস্নার উদ্দেশে। দুপুর গড়িয়ে গেলে কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) এসে পৌঁছেই দুপুর খাবার খেলাম। খাবার শেষে কুবি, শালবন বিহার, বৌদ্ধ মন্দির, বাংলাদেশ পলস্নী উন্নয়ন একাডেমি বা বার্ড ও ধর্মসাগর পরিদর্শন করলাম। বিশেষ করে বার্ডের ভিতরে প্রবেশ করতে শরীরের মধ্যে যেন বিশুদ্ধ নির্মল প্রকৃতি দোল খাচ্ছে। এত পরিচ্ছন্ন একটি প্রতিষ্ঠান, এত সুন্দর শৈল্পিক তার অবকাঠামো, এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে আসা-যাওয়ার জন্য ছাদযুক্ত ওয়াকওয়ে, আর তারই পার্শ্বে নানা রঙের ফুলের বাগান কার না চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে সবার কাছে এই স্থানটি ভালো লেগেছে। তবে কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (কুবিসাস) কথা না বললেই নয় তাদের সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করেছে। যতক্ষণ কুমিলস্নায় আমরা ছিলাম সার্বক্ষণিক তারা আমাদের জন্য ছোটাছুটি করেছে। তাদের জন্য আমাদের কুমিলস্না ভ্রমণ সহজ হয়ে গিয়েছে। সিলেট ও কুমিলস্না ভ্রমণ শেষে আমাদের ২০২২-এর টু্যরের সমাপ্তির পথে এসে গেছে। কুবিসাস ইবিসাসকে বিদায় জানানোর পর বাস চলতে লাগল ক্যাম্পাসের পথে। টানা তিন দিন চাররাত ভ্রমণ শেষে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। হাজারো স্মৃতির মিলন এসে জড়ো হলো। মনের কোণে রয়ে যাবে সিলেট ও কুমিলস্নার স্মৃতিচারণ। হাসি-আনন্দে সারাক্ষণ অতিবাহিত হয় আমাদের এ যাত্রা। ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে তোলা হয় নানা ভঙ্গিমায় স্থিরচিত্র। স্মৃতির পাতায় স্মৃতিময় হয়ে থাকবে সিলেট ও কুমিলস্না ভ্রমণ।