আমঝুপি নীলকুঠি থেকে মুজিবনগর নীলের দেশে আমরা!

প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আবির হোসেন, ইবি
যখন মাধ্যমিকে পড়তাম তখন আমার স্কুল ইউনিফর্ম ছিল সাদা শার্ট আর নেভি বস্নু প্যান্ট। সাদা শার্টটি ধোয়া শেষে দেখতাম মা বালতির পানিতে কয়েকফোঁটা নীল মিশিয়ে শার্টটি ডোবাতেন। তখন শার্টটি আরও বেশি ধবধবে সাদা হয়ে উঠত। এ দেখে অবাক হয়ে বড়দের কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতাম। তাদের মুখেই গল্প শুনতাম, এ দেশে নাকি একসময় এই নীলের ব্যাপক চাষ হতো। এই নীলেরও একটা ইতিহাস আছে, তবে তা নির্মমতা আর শোষণের। কিন্তু তখন এর ইতিহাস সম্পর্কে এতটা জানা হয়ে ওঠেনি। উচ্চ-মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে 'আল-ফিকহ্‌ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ' বিভাগ থেকে আমাদের সেশনের প্রথম বাৎসরিক টু্যরের আয়োজন করা হলো সেই নীলচাষের ইতিহাস সমৃদ্ধ মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি ও মুজিবনগরে। আমাদের বিভাগের শ্রদ্ধেয় সহযোগী অধ্যাপক আলতাফ হোসেন স্যারের উদ্যোগে এ আয়োজন। সবাই খুবই উৎসুক প্রথমবারের মতো বিভাগ থেকে টু্যরে যাওয়ার জন্য। শীতের সকালে আমরা সবাই ক্যাম্পাসের জিয়া মোড়ে একত্রিত হই। ঘন কুয়াশা ডিঙিয়ে আজ আমাদের মুক্ত আকাশে পাখা মেলার দিন। আজ থাকবে না কোনো বিভেদ, বন্ধুর আলিঙ্গনে শতবর্ষ দূরে হারাবে মনোমালিন্য। ততক্ষণে ক্যাম্পাস থেকে যারা বাসে উঠবে সবাই এসে গেছে, অনেকে আবার উঠবে ঝিনাইদহ শহর থেকে। যাত্রা শুরুর আগে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে আমাদের কিছু অসাধারণ ছবি ফ্রেমবন্দি করেন বিভাগের সিনিয়র নাছির উদ্দীন আবির ভাই। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রধান ফটকের সামনে থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। পিচঢালা রাস্তা মাড়িয়ে এগিয়ে চলে আমাদের লাল-সবুজের দ্বিতল বাসটি। বাসের নিচ তলায় বান্ধবীরা আর আমরা বন্ধুরা সবাই উপর তলায়। আমাদের সঙ্গে আছেন বিভাগের শ্রদ্ধেয় সভাপতি ডক্টর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন স্যার ও প্রফেসর ডক্টর এ কে এম নুরুল ইসলাম স্যার। আর মুজিবনগর পৌঁছানোর পরে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন প্রফেসর ডক্টর হামিদা খাতুন ও তার স্বামী মেহেরপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালের বিচারক তৌহিদুল ইসলাম। দুপুরের আগেই আমরা আমঝুপি নীলকুঠিতে পৌঁছাই। মেহেরপুর সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নে এর অবস্থান। আমঝুপির ৭৪ একর জমির ওপর নীল চাষ করা হতো, এর একটি বড় অংশজুড়ে গড়ে উঠেছে এই নীলকুঠি। এর সামনে দু'পাশে রয়েছে বৃহদাকার ইংরেজ আমলের শতবর্ষী দুটি গাছ, যা দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! বন্ধুদের মধ্যে থেকে কে যেন মজা করে বলে উঠল 'এই গাছ লর্ড ক্লাইভ নিজ হাতে লাগিয়েছে।' আমরা তার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। ততক্ষণে আমাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল। চারদিকে দেওয়ালে ঘেরা কুঠিবাড়ির সামনে স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্য কিছু গ্রম্নপ ফটো নেওয়া হলো। দরজার সামনে লেখা রয়েছে কুঠির ইতিহাস ঐতিহ্যের বর্ণনা, ডানে অফিস কক্ষ। দরজা দিয়ে ঢোকার পর প্রথমেই বাঁ পাশে রয়েছে একটি বিশেষ ঘর, নাম 'স্নেকপ্রম্নফ রুম', এ ঘরের মেঝে এতটাই মসৃণ যে এতে পিঁপড়াও হাঁটতে পারে না। ভেতরের ঘরগুলোর দেওয়ালজুড়ে নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন ছবি ও ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এর পেছনের অংশে নকশা করা রেলিংযুক্ত বারান্দা থেকে নামলেই দেখা যায় আরেকটি আকর্ষণীয় ছোট ঘর। সেখানে লেখা, 'ডাক বহনকারী কবুতরের ঘর', এর পাশেই কাজলা নদীর ঘাট। কবুতরের ঘরের অন্যপাশে আছে বিলুপ্তপ্রায় 'তালিপাম'। যার নাম পড়েছিলাম ইন্টারমিডিয়েটের জীব বিজ্ঞান বইয়ের দ্বিতীয় পত্রে, আজ সরাসরি দেখলাম। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেই ইতিহাসখ্যাত নীলগাছের দেখাও মিলল কুঠির ঠিক পেছনের ছোট্ট বাগানটিতে। আমঝুপি নীলকুঠির প্রতিটি দেওয়াল ইংরেজদের নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী। এখানে এলে নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণের বিভীষিকাময় ইতিহাস কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। বাংলায় ইংরেজদের শাসনকালে পুরো ভারতীয় মহাদেশে নীল বিপুল জনপ্রিয় ছিল। বাংলার মাটি ছিল নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। তাই ব্রিটিশ নীলকররা বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে নীল চাষে। নীল উৎপাদন লাভজনক ছিল ব্রিটিশদের জন্য কিন্তু তা বাংলার কৃষকদের জন্য ছিল ক্ষতির কারণ। এ কাজে যে ব্যয় হতো তার যৎসামান্যই পেতেন কৃষকরা, লাভের বেশি অংশ নিয়ে যেত ব্রিটিশরা। তারপরও পুরো বাংলার কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো। অবাধ্য ও বিদ্রোহী কৃষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন নীলকুঠিতে। তারপর তাদের কপালে জুটতো অবর্ণনীয় অত্যাচার। লোকমুখে প্রচলিত আছে, আমঝুপির এখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল এবং পলাশী যুদ্ধের নীলনকশা আঁকা হয়েছিল। দুপুরের পরে আমরা মুজিবনগরের পথ ধরি, যেখানে আমাদের স্বাধীনতার সূর্যোদয় হয়েছিল। আমঝুপি থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে মুজিবনগর। একসময় এর নাম ছিল 'বৈদ্যনাথতলা', এখানে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। সেখানে এসে আমাদের দুপুরের খাবার শেষে বিনোদন পর্ব শুরু হয়। ছেলেদের হাঁড়িভাঙা, মেয়েদের সুই-সুতা পরানো, ছেলেমেয়ে উভয়ের বাস্কেটে বল ছোড়াসহ বিভিন্ন ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। সবাই খুব উপভোগ করি, তারপর ঘুরতে বের হই। এখানে ২০ একর জায়গাজুড়ে এখনো রয়েছে সেই বিশাল আমের বাগান। মূল ফটকের সামনে আমাদের ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মরণে ২৩টি দেয়াল বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সম্মানে পুরো স্মৃতিসৌধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ৩০ লাখ পাথর। আর স্মৃতিসৌধের বেদিতে উঠতে ১১টি সিঁড়ি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ১১টি সেক্টরকে নির্দেশ করে। কমপেস্নক্সের মূল অংশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরসমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিশাল এক মানচিত্র। চারপাশের উঁচু ওয়াচ টাওয়ার থেকে এই মানচিত্র দেখলে ভিন্নরকম উপলব্ধি পাওয়া যায়। এ ছাড়া পুরোটাজুড়ে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন দৃশ্যের মু্যরাল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো, আমাদের ঘরে ফিরতে হবে। সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরির পরে ক্লান্ত সবাই গাড়িতে উঠে বসি। রাত ৯টার দিকে আমরা ফিরে আসি আমাদের চিরচেনা ১৭৫ একরে। এর আগে আমরা কখনো আমাদের বিভাগের শিক্ষকদের এভাবে কাছে পাইনি। তারা যে কতটা আনন্দপ্রিয়, আন্তরিক এবং অমায়িক হৃদয়ের অধিকারী তা আমরা এইদিন বুঝেছি। আর বন্ধুদের কথা তো বলাই লাগে না, সবাই যেন একই সুতোয় বোনা একটি ঘর। যে ঘর ভাঙবে না শত-সহস্র বছর। নিঃস্ব হয়ে যাবে সবাই, অনন্তকাল থেকে যাবে আমাদের বন্ধুত্ব।