নুহাশপলস্নীতে একদিন

প্রকাশ | ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

ইমরান হুসাইন
'এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে জল ভরা দৃষ্টিতে এসো কোমল শ্যামল ছায়' অনেক আগেই হুমায়ূন আহমেদ আহ্বান জানিয়েছিলেন তার নীড়ে। ঝর ঝর বৃষ্টিতে তার কোমল স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়ার তরে। তবে আমাদের যেতে একটু বিলম্ব হয়েছিল বটে। আহ্বানের কিছুটা ব্যতিক্রমও ঘটেছিল। বর্ষাকে উপেক্ষা করে বসন্তেই হাজির হয়েছিলাম নুহাশপলস্নীতে। নির্জীব সেই পলস্নী। নির্মল আকাশ। প্রখর সূর্য। গাছের পাতা ভাবলেশহীন। শান্ত সৌম্য পরিবেশ। উপরে লিচু, জাম আর শান্তির প্রতীক জলপাই গাছ। নিচে সবুজ ঘাসের গালিচা। যেন এক টুকরো শান্তি নিকেতন। এইখানে চিরনিদ্রায় উত্তরাধুনিক বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বলছিলাম নুহাশপলস্নীর কথা। হুমায়ূন আহমেদের সমাধির কথা। কিংবদন্তির পলস্নীর সৌন্দর্যের কথা। এ সবকিছু খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখতে ছুটে গেছিলাম আমরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের বার্ষিক বনভোজনে হিমুর সাজে হলুদ রঙে সজ্জিত হয়ে মিলিত হয়েছিলাম সবাই। খুব সকালে রাজধানী পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রওনা দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম রূপকথার স্বর্গরাজ্য নুহাশপলস্নীতে। যেখানে ঘন বন আর বিশাল গাছের কোমল ছায়া। নুহাশপলস্নীর পশ্চিম পাশের দেয়াল ঘেঁষেই কিংবদন্তির সমাধি। চারদিকে কাচের দেয়াল। ভেতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে শ্বেতপাথরের সমাধি। শিথানের পাশে কাচের উপর হুমায়ূন আহমেদের স্বাক্ষর করা ফলক। পুরো জায়গাজুড়ে সুনসান নীরবতা। নুহাশপলস্নীতে যাওয়ার ইচ্ছে অনেক দিনের। কিন্তু হয়ে ওঠেনি এর আগে। তবে এবার তা সফল হয়েছে। বিভাগের শিক্ষক মিল্টন বিশ্বাস, আরিফুল আবেদ (আদিত্য), রাহেল রাজিব, সোনিয়া পারভীন ও সাবরিন নাহার ম্যামের কল্যাণে তা সম্ভব হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন। আর তাদের সহযোগিতায় ছিল বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সাদামাটা নুহাশপলস্নী। ভেতরে প্রবেশে পর দেখলাম বড় চত্বর। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পুরো জায়গাটা। ডান পাশে জল ফোয়ারা, সুইমিং পুল। মা-ছেলের স্ট্যাচু। আমার চোখ খুঁজছিল সমাধিস্থল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বা পাশে সমাধি। সবার আগে সেখানে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম। হুমায়ূন আহমেদের সমাধিস্থলে গিয়ে মনে হলো এই চত্বরের প্রতিটি বালুকণায়, ঘাসে, জলে-স্থলে মিশে আছেন সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। এখানে যতটা অক্সিজেন আছে নিঃশ্বাস নেওয়ার সবটুকুতে মিশে আছেন ওই মানুষটি। এর কিছুটা পূর্বে দাবা ঘর। কাঠের তৈরি দাবার ঘুঁটি এখনো আছে। তবে ভেঙে যাচ্ছে অনেক। ঘরটাতে প্রচুর ধুলাবালি। বন্ধু ফাহিমসহ কয়েকজন খেলার চেষ্টাও করল কিছুক্ষণ। বাকিরা স্মৃতি রাখতে ছবি উঠানোয় ব্যাকুল। এদিকে বৃষ্টি বিলাস শূন্য। কে আর অমন শৈল্পিক বাসনায় বৃষ্টি দেখবে? একটা ভাঙ্গা মোড়া। কয়েকটা জীর্ণ সোফা। সবকিছুতেই অযত্নের ছাপ। বৃষ্টি বিলাস ভবনের ভেতরে পোড়ো বাড়ির মতো কয়েকটা খালি খাট। লোকজন নেই। সেখানে আমরাই রাজত্ব করলাম কিছুক্ষণ। পশ্চিম পাশের বিশাল টিনের ঘরের দিকে গেলাম না। মনে হচ্ছে কিছুই নেই ওতে। বটতলায় বুড়ো দৈত্য যেন শীর্ণকায়। তার নিচে মৎস্যকুমারী বড় একা! কোথাও কেউ নেই। তারপরেই জলসিঁড়ি সমৃদ্ধ বিশাল পুকুর। শহুরে যান্ত্রিকতার বাইরে এমন বিশাল পুকুর পাওয়া মানে অন্য উন্মাদনা। দল বেঁধে লাফ-ঝাঁপ-সাঁতার। হুমায়ূন আহমেদর সবচেয়ে প্রিয় জায়গাগুলোর একটা এই পুকুর ঘাট। যার নাম দীঘি লীলাবতী। এখানে তিনি অনেক সময় কাটিয়েছেন। অনেক নাটক-সিনেমার শুটিং করেছেন এখানে। পুকুরের উত্তর পাড়ে মাঝারি সাইজের বটগাছ। দক্ষিণে একটি নতুন একতলা ছোট ঘর। বৃষ্টি দেখার জন্য বোধহয় এর চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। পুকুরের মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপ। তাতে আছে গাছের ছায়া। সেখানে যাওয়ার জন্য একটি কাঠের সেতু। তবে তার অবস্থা এখন জীর্ণশীর্ণ। এর পরে দল বেঁধে সুইমিং পুলে গোসল, খেলা খুনসুটি। তারপরেই দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি। একে একে সবার খাওয়া শেষ হলে শুরু হয় খেলাধুলা আর র?্যাফেল ড্র। সেই সঙ্গে নামল সন্ধ্যা। সুনসান নীরবতায় আবার ছেয়ে গেল নুহাশপলস্নী। কৃত্তিম কোলাহল থামিয়ে বিদায় নিতে হলো ক্ষণিকের হিমুদের। এর পর বাসে উঠে সারাদিনের তৃপ্তি ও সৌন্দর্যের বর্ণনা সবার মুখে। হুমায়ূন আহমেদের সার্থকতা যেন এখানেই। সবাই বলে উঠল দিনটা ভালো কাটল। জায়গা সুন্দর। হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই বেঁচে আছেন বাংলায়। বাংলার মানুষের মনে। প্রকৃতির পাতায়। এ প্রজন্ম তাকে আজীবন স্মরণ করবে। হাজারও ভক্ত পাঠকের হৃদয়ে তিনি চির ভাস্মর হয়ে থাকবেন হিমুর চরিত্রে। বিচরণ করবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রূপার খোঁজে।