বান্দরবান নীলাচল প্রকৃতিকন্যার সান্নিধ্যে

প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

মোহাম্মদ এনামুল হক
বান্দরবান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর বিশেষত্ব শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি জেলা হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর জেলা হিসেবেও বান্দরবান জনপ্রিয়। এখানকার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে এর সবুজে ঢাকা পাহাড়, উন্মত্ত জলপ্রপাত এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। এই অভিজ্ঞতাগুলো পেতে হলে জানতে হবে কীভাবে এই সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করা যায়। তাই আমরা বান্দরবান নীলাচল প্রকৃতিকন্যার সান্নিধ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। আর আমাদের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা ভ্রমণে যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম। এক অপূর্ব সৌন্দর্যের মায়ায় পড়ে গিয়েছি। ব্যাগ ঘুছিয়ে ভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম বাসা থেকে। চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ মোড়ে সবার উপস্থিত হওয়ার কথা রয়েছে। আমি, মঈন ৩টা ২০ মিনেটেই বদ্দারহাট বাস টার্মিনাল মোড়ে পৌঁছালাম। হাবিব আগে থেকে সেখানে উপস্থিত। আমাকে দেখতেই হাবিব ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তখন আমরা একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে নিলাম। মানিক পূর্ব থেকে আমাদের বলে রেখেছিল কীভাবে যাবো। চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ আসার পর ঈগল বাস করে যেন আমরা রওনা হই। আমরা সবাই নতুন ব্রিজে ঈগল বাস খুঁজতে শুরু করলাম। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- সেখানে কোনো ঈগল বাস কাউন্টার নেই। তখন আমরা এ্যানা এক্সপ্রেস বাসে ১২০ টাকা টিকিট কেটে পদুয়ার উদ্দেশে রওনা হই। বাসের জানালার দিকে একটু করে মুখ ফেরাতে দেখি, গ্রামীণ পরিবেশের সৌন্দর্য, এমন একটি নিদর্শন দেখতে পারাটাও বেশ আনন্দের। আমি যেন এক কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে মঈন বলছে আমরা পদুয়া চলে আসছি নামো নামো। আমি বললাম সত্যি কি চলে আসছি? সে বলল হঁ্যা! সত্যি কথা বলতে কি! আমি লং টাইম বাস জার্নি করতে পারি না। আর যদি গ্রামীণ পরিবেশের কল্পনা জগতে না হারিয়ে যেতাম তাহলে মনে হয় আমার যাওয়া অসম্ভব হয়ে যেত। যাই হোক আমরা সন্ধ্যায় ৬টা ৩৭ মিনিট পৌঁছাই। আর আমাদের রিসিভ করার জন্য। মানিক আগে থেকেই পদুয়া উপস্থিত ছিল। মানিক আমাদের সবাইকে দেখতেই ঝাঁপিয়ে ধরেছে। বন্ধুরা একসাথে যা হয় আর কি। তারপর মানিক আমাদের তাদের সাতকানিয়া চিব্বাড়ী বাসা নিয়ে যায়। আমরা ফ্রেশ হওয়ার পর সেখানে সবাই বিশ্রাম নিই। কিছুক্ষণ পর মানিক নাশতা নিয়ে আসে সবাই নাশতা সেরে নিই। এরপর বন্ধুরা বসে লুডো খেলা শুরু করি। তারপর রাতের খাবার সেরে নিলাম। বন্ধুরা মিলে একটা রুমে আমরা রাত্রিযাপন করি। গল্প-আড্ডা, খুনসুটি, মাস্তি ইত্যাদি। আর সব বন্ধু একসাথে থাকলে যা হয় আর কি। তারপর সকালের নাশতা সেরে। গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আমরা চিব্বাড়ী গ্রামে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চিব্বাড়ী কলেজে যাই। দেখলাম অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য। আমাদের দেশের এমন সুন্দর সুন্দর স্থান রয়েছে। যা সত্যিই মনমুগ্ধকর! তারপর জুমার আজান হওয়ায় আমরা মসজিদে চলে যাই। জুমার নামাজ শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে সবাই দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এরপর আমরা বের হলাম বান্দরবান অন্যতম একটি স্থান- নীলাচল আর নীলাচল বান্দরবান প্রধান শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উপরে অবস্থিত। নীলাচলের বাইরের দিকটা ছিন্নভিন্ন পাহাড় দ্বারা সজ্জিত হলেও ভেতরটা খুব প্রশান্ত। কোথাও বিস্তীর্ণ দিগন্তের ঢালে ঘোরাঘুরির রাস্তা, কোথাও পাহাড়ি পাড়া, আর তার সঙ্গে রুপালি নদী যেন শিল্পীর আঁকা ছবি। মেঘহীন আকাশে নীলাচল থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা। শহর ছেড়ে চট্টগ্রামের পথে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে বাঁ দিকের ছোট্ট রাস্তাটি নীলাচলের পথ। এ পথে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ে উঠতে হবে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে পর্যটকদের নীলাচল পর্যটন স্পট। জেলা শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় নীলাচল অবস্থিত। স্পটটি স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। গাড়ি এবং হেঁটেও সহজে নীলাচলে যাওয়া যায়। তবে শুধু নীলাচলে যাওয়ার জন্য আলাদা কোনো সার্ভিসের ব্যবস্থা নেই। ভাড়াগাড়ি রিজার্ভ করে কিংবা নিজস্ব গাড়িতে করে এই স্পটে যেতে হয়। পর্যটকের সুবিধার জন্য নীলাচলে নির্মাণ করা হয়েছে আকর্ষণীয় কাচের টাওয়ার, দৃষ্টি নন্দন সিঁড়ি, গোলঘর এবং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। রাত্রিযাপনের জন্য তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় কয়েকটি কটেজও। পর্যটকদের নজর কাড়তে সক্ষম নীলাচল পর্যটন স্পটে গিয়ে যে কোনো মানুষ মুগ্ধ হতে বাধ্য। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের বিপরীতে এখানে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ি সমুদ্রের। যেদিকে চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের এই সমুদ্র প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনকে হার মানাতে বাধ্য। নীলাচল থেকে খোলা চোখে অনায়াসে দেখা যায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী। রাতের বেলা এখান থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে মনে হয় একেকটি গ্রহ-নক্ষত্র। ভূমি থেকে আকাশের তারাকে যে রূপে দেখা যায় কর্ণফুলীতে অবস্থানরত জাহাজগুলোও রাতের বেলা নীলাচল থেকে তেমনি মনে হয়। দিন আর রাতের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য নীলাচল পর্যটকদের কাছে আরও বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যায় নীলাচল থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অনায়াসে দেখা যায়। তবে নীলাচল পর্যটন স্পটে দিনের চেয়েও রাতের চাঁদের আলোয় সময় কাটানো যায় অতি রোমাঞ্চের মধ্যদিয়ে। চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এরপর সবকিছু গুছিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দেওয়ার পালা। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমরা কেরানীহাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে। কেরানীহাট বায়তুশ শরফ হোটেল হালকা-পাতলা নাশতা খেয়ে নিলাম। ততক্ষণ আমরা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল আরও কিছুদিন না- হয় থেকে যাই। কী সুন্দর সবকিছু! কিন্তু জীবনের তাগিদে ফিরে আসতে তো হবে। এরই মধ্যে সৌদিয়া গাড়ি পেলাম। গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম প্রিয় শহর চট্টগ্রামের উদ্দেশে।