সমুদ্র তীরে প্রশান্তির ছোঁয়া

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৩, ০০:০০

মুতাছিম বিলস্নাহ রিয়াদ
বাংলাদেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। হাজারও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় বছরজুড়ে মুখর থাকে পৃথিবীর দীর্ঘতম এই সৈকতটি। আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ভ্রমণে গিয়েছিলাম সেখানেই। দুইদিন ঘোরাঘুরি শেষে ফিরেছি একরাশ মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে। ৬ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সঙ্গে ছিলেন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান স্যার। বাসের মধ্যে সিনিয়র জুনিয়র সবাই এক সুরে বাঁধা পড়ল। একের পর এক চলতে থাকল নাচ, গান, কবিতা। এভাবেই ২২ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পরদিন দুপুর ২টার দিকে পৌঁছলাম কক্সবাজারে। আগে থেকেই আমাদের রিসোর্ট ঠিক করা ছিল। যে যার রুমে জিনিসপত্রাদি রেখে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি। পরে দুপুরের খাবার শেষে অল্প বিশ্রাম নেওয়া হলো। এরপর সবাই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র সৈকতের দিকে। পিচঢালা রাস্তার পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলেছি। সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে। রৌদ্রের প্রচন্ড তাপ উপেক্ষা করে জড়ো হলাম সমুদ্রের পাড়ে। সমুদ্রের বিস্তীর্ণ বালুকাবেলার উপর ফটোসেশন হলো। তারপর সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল উত্তাল সমুদ্রে। দৃষ্টির সীমানায় শুধুই থইথই জলরাশি। সমুদ্রের গর্জনে মুখরিত পুরো এলাকা। একের পর এক বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বন্ধুরা সবাই একে অপরকে ধরে ঢেউয়ের সঙ্গে ভাসতে শুরু করলাম। সমুদ্রের স্বচ্ছ নোনা জলে শুরু হলো জলকেলি। উত্তাল ঢেউয়ে দোল খেতে থাকলাম আমরাও। সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে গেল। হৃদয়জুড়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। সমুদ্রে ঝাপাঝাপি আর স্নান করতে করতে সূর্যটা এক সময় পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল। পরে সমুদ্রতটে এসে আবারও শুরু হলো ফটোসেশন। সূর্যাস্তের সময় যেন এক স্বর্গীয় আবহ সৃষ্টি হলো সেখানে। সন্ধ্যার পূর্বলগ্নে সূর্যের আলো সাগরে আছড়ে পড়ছে। গোধূলি লগ্নে রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে চারদিক। মৃদু ঠান্ডা বাতাসে ভাসছে সমুদ্রের গর্জন। বিচের চারদিকে লোকে লোকারণ্য। দু'নয়ন ভরে দেখছি সব। কোনো আড়ম্বর নেই এখানে, নেই কোনো কৃত্তিমতা। আছে শুধু প্রকৃতির নিজস্ব তুলিতে আঁকা অপরূপ চিত্রপট। সন্ধ্যায় যার যার রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রাতে সবাই আবারও বেরিয়ে পড়লাম। সমুদ্রের পাশেই রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য দোকান। ঝিনুক-শামুক, কাঁকড়া ও প্রবালের দোকানের পাশাপাশি বার্মিজ পণ্যসামগ্রী, কসমেটিক্স, শুঁটকি, ফাস্ট ফুডসহ নানা রকমের দোকানের সমাহার এখানে। সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীর দেহাবশেষ দিয়ে তৈরি নজড়কাড়া বাহারি রকমের জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়েছে দোকানগুলো। রয়েছে শত প্রজাতির সামুদ্রিক শুঁটকি মাছের সমাহার। এ ছাড়া রাস্তার দুই ধারে সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছ নিয়ে বসেছে দোকানিরা। সমুদ্র থেকে ধরা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থরে থরে সাজানো দোকানগুলোতে। কোরাল, টুনা ও স্যামন ফিশসহ বেশকিছু সামুদ্রিক মাছের স্বাদ আস্বাদন করা হলো সেই রাতে। পরে গভীর রাত পর্যন্ত সমুদ্রের পাড়ে মজেছিলাম গল্প আর আড্ডায়। পরদিন সকালে খোলা জিপে চড়ে রওনা হই ইনানী সৈকতের উদ্দেশে। যা কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে ইনানী বিচ দীর্ঘ প্রায় ২৮ কিলোমিটা দূরে। পিচঢালা মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে গাড়ি ছুটছে দুরন্ত বেগে। একপাশে বিস্তীর্ণ সমুদ্রের বালুকাবেলা। আরেকপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি। মনে হবে কোন স্বপ্নের দেশে ভেসে যাচ্ছি। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলা খোলা জিপে দাঁড়িয়ে দু'পাশের এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখে হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠল। এ যেন কাব্যিক, স্বপ্নের মতো সুন্দর। যাত্রা শুরুর ঘণ্টা খনিকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ইনানী বিচে। বিচের নজরকাড়া সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত না হয়ে উপাই নেই। একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে দিগন্ত বিস্তৃত থইথই নীল জলরাশি। সমুদ্র তীরে নারিকেল ও ঝাউবন গাছের সারি। স্বচ্ছ নীলাভ জলে ছোটাছুটি করছে সাম্পান ও ছোট ছোট ইঞ্জিন বোট। এ যেন প্রকৃতি তার খেয়ালে সব সৌন্দর্য অপরূপভাবে সাজিয়ে রেখেছে। চারপাশে এমন অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে মন প্রফুলস্ন হয়ে উঠবে যে কারোরই। ইনানী বিচ ঘোরা শেষে ফিরতি পথে যাওয়া হলো হিমছড়ি পাহাড় ও ইকো টু্যরিজম কেন্দ্রে। দেশের একমাত্র 'ঠান্ডা জলপ্রপাত' হিমছড়ি ঝর্ণা এখানেই অবস্থিত। খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে পাহাড় চূড়ায় উঠতে গিয়ে সূর্যের প্রচন্ড তাপে সবার অবস্থা নাস্তানাবুদ। পাহাড়ে উঠতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া বিশাল সমুদ্র। পরক্ষণেই সজীবতার পরশে শরীর ও মন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। যাবতীয় ক্লান্তি ছুটে গিয়ে শীতলতা নেমে আসে হৃদয়জুড়ে। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। প্রকৃতি মানুষকে প্রকৃত জীবনবোধ শেখায়। প্রকৃতির কৃপায় আমরা জীবনকে উপভোগ্য করে তুলি। মনের রং যখন থাকে ধূসর ও বৈচিত্র্যহীন, প্রকৃতির সান্নিধ্যে তখন হয়ে ওঠে রঙিন। অনিন্দ্যসুন্দর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ স্মৃতির পাতায় লেপ্টে থাকবে আজীবন।