রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

গৌরবের ৬৫ বছরে উত্তরের মতিহার

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

নাজমুল মৃধা পাভেল
আনন্দ শোভাযাত্রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষাথীর্রা
ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত একে অন্যের সঙ্গে। আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি এই তিনটি যেমন। সবকিছুতেই সেরা, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদান বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এনে দেয় এক অনন্য মাত্রা। হাজারো শিক্ষাথীের্দর আবেগের জায়গা, ভালোবাসার সবের্শষ আশ্রয়স্থল। সাবেকদের অবসরের স্মৃতি, বতর্মানদের রাজ্যনাভূতি মিলেমিশে একাকার। ৬ জুলাই গৌরবের ৬৬তম বষের্ পদাপর্ণ করেছে এ ক্যাম্পাস মাতা। নানা চড়াই-উৎড়াই আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মেলবন্ধনে গড়া ভালোবাসার সেতুর আরেক নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আদর করে শিক্ষাথীর্রা ডাকে ‘মতিহার’। এ সেতু ছোট থেকে বড় হওয়ার, নিচু থেকে উপরে ওঠার। বিদ্যার দেবীকে আপন করে নেওয়ার, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। দিবসটি উপলক্ষে ৬ জুলাই ‘এ শুভলগনে জাগুক গগণে অমৃত বায়ু’ ¯েøাগানকে সামনে রেখে বণার্ঢ্য শোভাযাত্রাসহ নানা আয়োজন করে প্রশাসন। ইতিহাস, গৌরব আর ঐতিহ্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অহঙ্কার। দেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূণর্ আন্দোলনে সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দামাল ছেলেরা যা এখনো অব্যাহত। শিক্ষা, গবেষণা, আবিষ্কারে এ ক্যাম্পাস উপহার দিয়েছে সূযর্সন্তানদের। অনাবিল সৌন্দযর্ আর প্রকৃতির নিঝুম ছেঁায়া হৃদয়ে এনে দেয় গভীর প্রশান্তি । এর নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শায়িত আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব, জাতির অহংকার শহীদ শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা, শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ। গণ-অভ্যুথানে শিক্ষাথীের্দর বঁাচাতে পুলিশের গুলিতে নিহত রসায়ন বিভাগের শিক্ষক তৎকালীন প্রক্টর শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে সবাই জানে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পযাের্য় দেশকে ভালোবেসে পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হন শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার, এবং মীর আব্দুল কাইয়ুম। এ ছাড়া পাকিস্তানিদের দ্বারা অকথ্য নিযার্তন ভোগ করেছেন তৎকালীন গণিত বিভাগের শিক্ষক মজিবর রহমান। এ ছাড়া নাম না জানা অন্তত আরও ত্রিশ জন ছাত্র, শিক্ষক, কমর্কতার্-কমর্চারী মুক্তিযুদ্ধে নিহত হন। এদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে গৌরবান্বিত করেছে এমন শিক্ষাথীর্, তারা হলেনÑ বিশিষ্ট নাট্যকার মলয় কুমার ভৌমিক, বিশিষ্ট গণিতবিদ সুব্রত মজুমদার, দেশবরেণ্য অভিনেত্রী শমির্লী আহমেদ, বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এÐ্রু কিশোর, ইমিরেটাস প্রফেসর অরুণ কুমার বসাক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী কবি মহাদেব সাহা, বিশিষ্ট বিচারক কৃষ্ণা দেবনাথ, চলচ্চিত্র নিমার্তা গিয়াস উদ্দিন সেলিম, ক্রিকেটার আল-আমিন হোসেন, দেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক প্রমুখ। এ ছাড়াও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বনামধন্য শিক্ষকদের মধ্যে আছেন ডেভিড কফ, ড. শামসুজ্জোহা, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার এম সাইদুর রহমান, তাত্তি¡ক ও সমালোচক বদরুদ্দিন উমর, নৃবিজ্ঞানী পিটার বাউচি, উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হক প্রমুখ। ১৯৫৩ সালের ৩১ মাচর্ প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। একই বছরের ৬ জুলাই ড. ইৎরাত হোসেন জুবেরিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সময় পদ্মাপাড়ের বড় কুঠি ও রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাযর্ক্রম শুরু হয়। ১৯৬১ সালে বড় কুঠি থেকে নয়নাভিরাম মতিহারের এ সবুজ চত্বরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাযর্ক্রম। রাজশাহী শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত এ ক্যাম্পাসটি ৩০৩ দশমিক ৮০ হেক্টর জমিতে স্থাপিত। শুরুতে দশর্ন, ইতিহাস, বাংলা, ইংরেজি, অথর্নীতি, গণিত ও আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোসর্ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বতর্মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৮টি বিভাগ রয়েছে। তাছাড়া উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ৫টি ইনস্টিটিউট। শিক্ষক রয়েছে প্রায় সাড়ে ১২শ এবং শিক্ষাথীর্ রয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার। এ ছাড়া শিক্ষাথীের্দর জন্য আবাসিক হল রয়েছে ১৭টি। এ ছাড়া দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। আছে তিনটি সাংবাদিক সংগঠন। ১৫টি সংগঠন নিয়ে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট। আছে দুটি বিতকর্ সংগঠনসহ ছোট বড় প্রায় একশর উপরে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন। সাধারণ শিক্ষাথীর্ ও গবেষকদের শিক্ষা সহায়ক হিসেবে এখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরি, বিভাগীয় কম্পিউটার ল্যাব, ইনস্টিটিউট ও অনুষদ লাইব্রেরি, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ও লাইব্রেরি এবং কম্পিউটার সেন্টার। সংস্কৃতি চচার্র জন্য রয়েছে শিক্ষক-ছাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র । এ ছাড়া খেলাধুলার জন্য আছে ২০ হাজার দশর্ক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল, এবং বিশাল জিমনেশিয়াম ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের নিদশর্ন ‘সাবাস বাংলাদেশ’ ভাস্কযর্, বধ্যভ‚মি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক। ক্যাম্পাসকে সৌন্দযর্ দান করেছে বিশাল প্রশস্ত প্যারিস রোডসহ রাশি রাশি আমবাগান। এ ছাড়া নিবিড় পিচঢালা রাস্তা ক্যাম্পাসের নিমর্ল পরিবেশকে দান করেছে অমায়িক প্রশান্তি। ৬ জুলাই ৬৫ বছরের সফল পথচলা পেরিয়ে ৬৬ বছরে পদাপর্ণ করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ৬৬তম জন্মদিনে প্রিয় ক্যাম্পাসকে জানাই অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং অভিনন্দন।