তারুণ্যের স্মৃতিতে ঈদ আনন্দ
বছর ঘুরে ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। শত সহস্র আনন্দের মাঝেও কিছু বিষাদ লুকিয়ে থাকে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঈদ উদযাপনের ভিন্নতা এসেছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে শৈশবের ঈদ আয়োজন কতখানি টানছে তরুণ প্রজন্মকে তা জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
ঈদ আনন্দে পরিবর্তন এসেছে
নওশীন ফারহান নওমী
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নির্মল সুখ। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনের পর ঈদ আসে আনন্দের আমেজ নিয়ে। শৈশব থেকেই বছর ঘুরে দুটি ঈদ আসা মানেই মনের মধ্যে আনন্দ বিরাজ করত। ছোটবেলায় ঈদ বলতেই নতুন জামা। ঈদ উপলক্ষে বাসার বড়রা সব আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে দাওয়াত দেওয়ার প্রচলন ছিল। এখন যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে ফোনের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া হয়। ছোটবেলা ঈদের সকালবেলা নতুন জামা পরে বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু ঘুরাঘুরি করতাম। ঈদের দিন বন্ধুবান্ধব মিলে সবার নানুর বাসায় ঘুরতে যেতাম। অনেক ঈদ সালামি পেতাম। ঈদের দিন বিকেল বেলা পারিবারিক গল্প-আড্ডার আসর বসত। এখন এসব স্মৃতি। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে ঈদ আনন্দের উচ্ছ্বাসে পরিবর্তন এসেছে। বিগত ৫-৬ বছর ধরে ঈদের দিনগুলো যেন স্বাভাবিক দিনের মতোই মনে হয়। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন ঘরে বসেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা হয়, গ্রম্নপ কলেই বন্ধুবান্ধব, কাজিনদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। ঈদের দিন বাইরে ঘুরতে যাওয়ার মনমানসিকতা আর হয়ে উঠে না যা খুব মিস করি। এখনকার ঈদ আনন্দটা চার দেওয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে গেছে। সর্বোপরি সবাইকে অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা রইল, ঈদের আনন্দ সবার সাথে ভাগাভাগি করে কাটুক।
সালামি পাওয়ার আনন্দ পাওয়া যায় না
কামরান চৌধুরী
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
শৈশবের ঈদ উদযাপন এবং বর্তমানের ঈদ উদযাপনের মাঝে যেন অনেক ভিন্নতা খুঁজে পাই। সময় এবং বয়সের সাথে সাথে আমাদের ঈদ উদযাপন ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। শৈশবের বেশিরভাগ সময় নিজ গ্রামে ঈদ পালন করা হতো। এখনো করা হয়, তবে আগের মতো ঈদের সেই আনন্দ অনুভূত হয় না। শৈশবে আমাদের ঈদের আমেজ শুরু হতো চাঁদরাত থেকে। পরের দিন ঈদের নামাজ আদায় করে সমবয়সি কিছু বন্ধুরা মিলে গ্রামের পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতাম। প্রত্যেকের বাড়িতে সেইদিন হরেকরকম খাবারের আয়োজন ছিল। কারও বাড়ি থেকে না খেয়ে আসা যেত না, সেই সঙ্গে সালামিও পেতাম। সালামি হাতে পেল খুব খুশি লাগত। কারণ, খেলার কিছু সামগ্রী কেনার টাকা হয়ে যেত। ঈদের দিন পুরো একটা গ্রাম যেন লোকজনের সমারোহে গম গম করত। ঈদের দিন এখন গ্রামের পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে কিছুটা কম যাওয়া হয়, তবে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া, সমবয়সিদের সাথে ঘুরে বেড়ানো এসব বেশ ভালো লাগে। তবে ঈদ সালামি পাওয়ার সেই আনন্দটা পাওয়া যায় না। আগের দিনগুলো খুব অনুভব করি।
ঈদের দিন যেন ঘুমানোর ছুটি
মো. জুবাইল আকন্দ
শিক্ষার্থী, ইম্পেরিয়াম ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া।
একের পর এক ঈদ যায়, প্রবাসীদের রয়ে যায় নিঃসঙ্গতা আর হতাশা। প্রবাস মানে দুঃখের তরঙ্গ বেয়ে সাত সমুদ্র পাড়িয়ে দিয়ে মনের আনন্দটাকে খাঁচায় বন্দি করে পরিবারের স্বপ্নটাকে লালন করা। প্রবাসীদের ঈদ উদযাপন যেন একেবারেই ভিন্ন। প্রবাসে ঈদ আমার কাছে একেবারে সাদামাটা, যদি এক কথায় বলি ঈদ মানে ঈদই নয়, নেই কোনো আনন্দ। প্রবাসীদের ঈদ মানে নিজের আনন্দকে পরিবারের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া। প্রবাসীর রোজগারে দেশে পরিবারের সদস্যদের নতুন পোশাক আর নানা আবদার মিটে যায়, কেউ কেউ অতৃপ্ত হয়ে রাগও করে কিন্তু কেউ খুঁজ নেয় না প্রবাসে থাকা মানুষটি কিছু কিনেছে কি না নিজের জন্য। পুরনো কাপড় চোপড় আর নিত্যদিনের মতো খাবার খেয়েই ঈদের দিন কাটে। প্রবাসে ঈদ প্রতিদিনের মতো। শত কর্মব্যস্ততার মাঝে ঈদের ছুটিতে লম্বা ঘুম অধিকাংশ প্রবাসীদের ঈদের দিনের মূল কর্মসূচি হয়ে থাকে। এভাবেই কেটে যায় প্রবাসীদের ঈদ নামে নিঃসঙ্গ বেদনার দিনটি।
রূপান্তরিত হচ্ছে ঈদ আনন্দ
তানজিদ শুভ্র
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
সময়ের পালা বাদলে ঈদ আয়োজনে বৈচিত্র্য এসেছে, এসেছে নতুনত্ব। তবুও আমাদের স্মৃতিতে নাড়া দেয় শৈশবে ফেলে আসা ঈদের আনন্দময় স্মৃতি। কৈশোরে কাটানো ঈদের আনন্দ যেন আর ফিরে আসবে না। একটা সময় ছিল যখন ঈদ উপলক্ষে কেনা নতুন জামা, জুতো লুকিয়ে রাখতাম এই ভেবে যে অন্য কেউ দেখে নিলে 'ঈদ' চলে যাবে। কোথায় এখন সেই উচ্ছ্বাস? যান্ত্রিকতার ভিড়ে প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে আমরা বরং উলটো পথে হাঁটছি। খেয়াল করলেই দেখা যাবে এখন কেনাকাটা করতে যাওয়া থেকে কী কী কেনা হলো তার সবই সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করি আমরা তাৎক্ষণিক। একসময় লুকিয়ে রেখে যে আনন্দ পেতাম এই সময়ে এসে ঠিক প্রকাশ করে ততটা আনন্দিত হই। আমাদের সোনালি শৈশবে অপেক্ষা করতাম বাড়ির বাইরে থাকা প্রতিবেশীরা ঈদ উপলক্ষে কবে বাড়ি ফিরবে? তাদের সাথে অনেকদিন পর দেখা হবে। আর বাস্তবতা মেনে এখন অপেক্ষা করি কবে বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে দেখা করব। প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে বড়দের থেকে নতুন নোটে সালামির বিকল্প হয়ে উঠেছে ডিজিটাল লেনদেনে ঈদ সালামি পাওয়া, ঈদ কার্ডের পরিবর্তে ম্যাসেজে শুভেচ্ছা বিনিময় অহরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম নানা বিকল্পে ঈদ আনন্দ রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, ফেলে আসা শৈশবের ঈদ আনন্দ এখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঈদ মানে কে কত সালামি পেল তার
হিসাব নেওয়া
হিমেল আহমেদ
শিক্ষার্থী, শহীদ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাজারীবাগ, ঢাকা।
ঈদ মানেই এক বাঁধ ভাঙা আনন্দ। বছরে শুধু দুই ঈদের দিনই নয়, আমরা আমাদের অনেক আনন্দকে ঈদের সাথে তুলনা করে বলে উঠি 'আজ তো আমার ঈদের দিন!'
জীবন চক্রে প্রতিটি পর্যায়ে জীবনের উপভোগ হয় ভিন্নতর। ফেলে আসা শৈশবে ঈদ মানেই ছিল নতুন জামা কাপড় ও বড়দের থেকে প্রাপ্য সালামি নিয়ে মাতামাতি করা। আর ঐ বয়সে এই সালামি চলে যেত দিনশেষে মায়ের কাছে। এমন স্মৃতি হয়ত আমার মতো অনেকেরই সোনালি অতীত। এ তো গেল সালামির কথা, আর নতুন জামা নিয়ে এত আবেগ কাজ করত যে বালিশের পাশে নিয়ে শান্তির ঘুম দেওয়া হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে ভিন্নতা আসে এই আনন্দ উপভোগেও। বয়স যখন আরেকটু বাড়ল তখন ঈদ মানেই ঘোরাঘুরি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি আর কে কত সালামি পেল এই নিয়ে আলোচনা করা। ঈদ কার্ডও ছিল সে সময়ের উচ্ছ্বাসের জায়গা। সময় বদলেছে। নতুন জামা-কাপড়ের প্রতি তেমন একটা ঝোঁক নেই। ভিন্নতার মাঝেও আনন্দের কমতি নেই, ঈদ আনন্দ আছেই।