সবুজে মোড়া সংস্কৃতির নগরী

কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু লাল মাটির ঢাল নেমে গেছে আবার কোথাও সমতল। রাস্তার দু’ধার দিয়ে সারি সারি গাছের সমারোহ, গাছের ডালে কিচির মিচির করছে হাজারো নাম না জানা পাখি। আবার রয়েছে একাধিক লেক যেন সবুজের সমারোহে পানির মেলা কি অপরূপ তার দৃশ্য...

প্রকাশ | ২৫ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

রুদ্র আজাদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের লেকে বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাখি এসে থাকে
কেউ বলে রূপের নগরী, কেউ বলে সবুজের নগরী আবার কেউ বলে সংস্কৃতির নগরী। এ ছাড়া প্রতিবাদের নগরী আবার লোকমুখে নাকি এটাও শোনা যায় এটা র‌্যাগের নগরী! সব মিলিয়ে বলা যায় এটা একটা রহস্যময় নগরী যার অবস্থান ঘনবসতিপূণর্ নগরী ঢাকার অদূরবতীর্ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কোল ঘেঁষে সাভারের কোলাহলমুক্ত এলাকায়। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকলে হয়তো এই জাহাঙ্গীরনগর নিয়ে একটা কবিতা লিখেই ফেলতেন আর সেখানে আকুতি থাকত পরজনমে জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ বৃক্ষ হয়ে জন্মানোর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তার লালিত সন্তানদের মাধ্যমে দেশ সেবায় অবদান রেখে যাচ্ছে, আর কেনইবা রাখবে না জাহাঙ্গীরনগর তার আগত সন্তানদের সুউচ্চ শহীদ মিনারের মতো বিশাল হৃদয় আর সবুজের মতো কোমল হৃদয়ের অবরূপে যে গঠন করে থাকে। কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু লাল মাটির ঢাল নেমে গেছে আবার কোথাও সমতল। রাস্তার দু’ধার দিয়ে সারি সারি গাছের সমারোহ, গাছের ডালে কিচির মিচির করছে হাজারো নাম না জানা পাখি। আবার রয়েছে একাধিক লেক যেন সবুজের সমারোহে পানির মেলা কি অপরূপ তার দৃশ্য। কি নেই এ নগরীতে! জীবনানন্দ দাশ যেন শত বছর পূবের্ এ জাহাঙ্গীরনগরের রূপ দেখে দু’দÐ কবিতা লিখেই ফেলেছিলেনÑ রৌদ্রের দুপুর ভরে বারবার রোদ তার চিকন সোনালি চুল কঁাঠাল জামের বুকে নিংড়ায়- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল, উলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিছু কঁাঠালের বন, মেঠোপথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধুল পছন্দের শীষের্ জাহাঙ্গীরনগর জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় শুধু তার প্রাকৃতিক গুণমুগ্ধতার জন্যই বিখ্যাত না জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ^বিদ্যালয়। এখানে ভতির্ হওয়ার সুযোগ সবাই কাজে লাগাতে চায় বিশেষ করে প্রান্তিক গ্রাম থেকে উঠে আসা মেধাবীদের আকষের্ণর জায়গা থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় বিগত কয়েক বছরের ভতির্ পরিক্ষাথীর্র সংখ্যা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয় গত ২০১৬-১৭ শিক্ষাবছরে ভতির্ পরীক্ষাথীর্ ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ২৯৮ জন বিপরীতে আসনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০৩০টি অথর্্যাৎ প্রতিটি আসনের বিপরীতে প্রাথীর্ ১০৯ জন! আবার ২০১৭-১৮ শিক্ষাবছরে ভতির্ পরিক্ষাথীর্ ছিল ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ১৭১ জন আর বিপরীতে আসনসংখ্যা ছিল ১৯৮৬টি অথর্্যাৎ প্রতিটি আসনের বিপরীতে ১৫১ জন! হয়তো এভাবে ভতির্চ্ছুক ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়তেই থাকবে। এছাড়া বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বাড়ছে গবেষণার পরিসর। বতর্মানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে রয়েছে মোট ছয়টি অনুষদ ৩৪টি বিভাগ এবং ইনস্টিটিউট রয়েছে ৩টি লেখাপড়া করছে ১৫ হাজারের ও বেশি শিক্ষাথীর্। এ ছাড়া আবাসিক হল রয়েছে মোট ১৬টি তার মধ্যে ছেলেদের হলো ৮টি, বাকি ৮টি হলো মেয়েদের। সবোর্চ্চ শহীদ মিনার জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার। ঘন সবুজরে আস্তরনের মাঝে লাল ইটের তৈরি সুবিশাল শহীদ মিনার যেন শহীদদের তাজা রক্ত সবুজ জমিন লাল করে দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই শহীদ মিনারের স্থপতি হলেন রবিউল হুসাইন এটি ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে ৫২ ফুট ব্যাস ও ৭১ ফুট উচ্চতা নিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে। এ ছাড়া রয়েছে ৮ সিঁড়ি এবং ৩টি স্তম্ভ, ৮টি সিঁড়ি বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ ও বিজয়ের ঘোষণার গৌরবোজ্জ্বল বছরগুলো প্রকাশ করে যেমন ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ও ১৯৭১ এর সংগ্রামের ইতিহাস। আর ৩টি স্তম্ভ বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, মাটিও মানুষ এবং স্বাধীনতা-সাবের্ভৗমত্ব-অথৈর্নতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক মুক্তির চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে। সংস্কৃতির রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়কে বলা হয় সংস্কৃতির রাজধানী, শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্নভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের হিসেব মতে মোট ১৪৮টি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। রয়েছে সেলিম আল দীন নামক বৃহৎ মুক্তমঞ্চ যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল ১৯৮১ সালে লাল ইটের কারুকাযের্ গঠিত এ মুক্তমঞ্চে রয়েছে ১৪টি সিঁড়ি এবং এক হাজার দুই শত মানুষের বসার জায়গা। এ নগরীতে যেন সন্ধ্যা নামে মুক্তমঞ্চের সুরেলা ধ্বনির মাধ্যমে, প্রায় সময় বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন, বিভাগ ও ব্যাচের মনোমুগ্ধকর আয়োজনে মেতে থাকে মুক্ত মঞ্চ। শীতের অতিথিশালা শীতকালীন সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় একটি অতিথিশালায় রূপান্তরিত হয়। বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে সাইবেরীয়, মঙ্গোলিয়া, নেপাল ও ভারত থেকে নাম না জানা হরেক রকমের পাখি শত মাইলের পথ অতিক্রম করে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে আসে এ নগরীতে। বিশ^বিদ্যালয়ের ছোট বড় মোট ১৪-১৫টি লেকের মধ্যে কয়েকটি লেকে এসব পাখি এসে থাকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর অতিরিক্ত লোকের সমাগম বিশ^বিদ্যালয় অভ্যন্তরে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ি চলাচলের কারণে প্রতি বছর অতিথি পাখির এ পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিবাদের নগরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় সম্পকের্ একটা কথা প্রচলিত আছে এখানে অন্যায় করে কেউ পার পেয়ে যেতে পারে না শাস্তি তাকে পেতেই হয় হোক তিনি শিক্ষক অথবা ছাত্র-ছাত্রী। ফলশ্রæতিতে দেখা যায় মাঝে মাঝে এ শান্ত নগরী ফুলেফেঁপে গজর্ন করে ওঠে সমস্ত শক্তি দিয়ে অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদ করে। বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত হওয়া ধষর্ণ ও নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন সেই স্বাক্ষর বহন করে। এ নগরীতে অন্যায়ের কাছে কেউ মাথা নত করে না বরং অন্যায় জাহাঙ্গীরনগরের কাছে সবর্দা মাথা নত করে চলে। ১৯৯৮-এর ধষর্ণবিরোধী আন্দোলন, বিভিন্ন সময়ে উপাচাযর্ ও প্রশাসনের গৃহিত অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের মোট ১৯ জন উপাচাযের্র মধ্যে ৫ জন উপাচাযর্ বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস প্রতিবাদের ইতিহাস।