দারুচিনি দ্বীপে একদিন

সেন্টমার্টিন মানেই হচ্ছে দারুচিনি দ্বীপ। কিন্তু সেন্টমার্টিনে যে সত্যি সত্যিই 'দারুচিনি দ্বীপ' নামে একটা আলাদা জায়গা আছে, সেটা কি আর আমি ভেবেছিলাম? তাই ব্যাপারটা জানা মাত্রই ছুটলাম সত্যিকারের দারুচিনি দ্বীপ দেখতে...

প্রকাশ | ১৮ মে ২০১৯, ০০:০০

ফাইজুন নাহার সিফাত
জাহাজ চলছে তো চলছেই। এক সময় মিয়ানমারের সীমানা দেখা গেল দূরে। যাত্রীরা চাপা উত্তেজনা নিয়ে ডেকে দাঁড়িয়ে মিয়ানমার দেখতে লাগলেন। আমরাও অন্যদের মতোই মিয়ানমার দেখা শুরু করলাম। আমরা মানে- আব্বু, আম্মু, আপু, আমি আর আমার কাকার পরিবার। আরও অনেকক্ষণ পরে শুনতে পেলাম, সেন্টমার্টিন পৌঁছে গিয়েছি আমরা। এত লম্বা জার্নি করার কষ্ট সার্থক মনে হলো। অবশেষে আমি দারুচিনি দ্বীপে, সেই স্বপ্নের সেন্টমার্টিন! সেন্টমার্টিনে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল স্বচ্ছ পানি। পানির রঙ কোথাও নীল আবার কোথাও সবুজ। একটু ভেতরে গিয়েই দেখলাম সারিসারি দোকান, সেখানে মূলত বিভিন্ন ধরনের সি-ফুড বিক্রি করেন স্থানীয়রা। তাজা মাছ, শুঁটকি- সব দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আকর্ষণীয়ভাবে। পাশাপাশি আছে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের দোকান। আমরা প্রথমেই সেখান থেকে সবার জন্য হ্যাট কিনে নিলাম রোদ থেকে বাঁচার জন্য। হঁ্যা, শীতকাল হলেও সেন্টমার্টিনে শীতের তেমন প্রকোপ দেখলাম না, রোদের প্রতাপই বেশি মনে হলো। চারপাশে ঘরবাড়ি বলতে কেবল হোটেল চোখে পড়ল। তাও উঁচু কোনো ভবন নয়। বলতে গেলে সব ভবনই একতলা। ইলেকট্রিসিটি নেই বেশিরভাগ হোটেলেই। সেখানকার স্থানীয় যানবাহন বলতে শুধু বিশেষ একধরনের ভ্যান দেখলাম। সেই ভ্যানে করেই গেলাম আমাদের রিসোর্টে। ভ্যানচালকদের কাছ থেকেই জেনে নিলাম ঘুরতে যাওয়ার বিশেষ জায়গা কোনগুলো। সেন্টমার্টিনের মেইন বিচেও আছে শুঁটকি আর তাজা মাছের পসরা। রূপচাঁদা, লবস্টার, উড়ুক্কু মাছ, কাঁকড়া আর চিংড়ি চিনতে পারলাম। ছুরি মাছও দেখলাম। মাছ পছন্দ করে দিলে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ভেজে দেয়। ঝাউগাছের সারি আর নীল সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে সি-ফুড খাওয়ার মজাই আলাদা। অবশ্য আমি মেইন বিচে গিয়ে একটা জিনিসই বারবার খুঁজছিলাম, 'সমুদ্র বিলাস', হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বাড়ি! খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও গেলাম। প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত বলে ভেতরে যেতে পারলাম না অবশ্য। কিন্তু বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়েই দেখে নিলাম। ভেতরে যেতে পারলে অনেক খুশি হতাম, তবে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ির সামনে একটি ছবি তুলতে পেরেও আমি কম আনন্দিত ছিলাম না। হালকা ঝাল দেয়া রূপচাঁদা, লবস্টার আর চিংড়ি খেয়ে, সূর্যোদয় দেখে সেদিনের মতো রিসোর্টে ফিরলাম। (দ্বিতীয়বার ভ্যানের ভাড়া ঠিক করে নিতেও ভুল করিনি।) পরেরদিন আমাদের মিশন ছেঁড়াদ্বীপ। বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের স্থান। আমরা ভেবেছিলাম, ছোট্ট একটা জায়গা, এক ঘণ্টার মধ্যে দেখে চলে আসব। কিন্তু হলো তার উল্টো। ছেঁড়াদ্বীপের স্বচ্ছ পানি দেখে সবাই গোসল করেই কাটিয়ে দিলাম অনেকটা সময়। তারপর ঘুরেটুরে সব দেখতে দেখতে সারাদিন লেগে গেল। কেয়া গাছের ঝোপের অভাব নেই সেখানে। হাঁটতে হাঁটতে প্রবালের ওপর অদ্ভুত কী একটা দেখা গেল। একটা পটকা মাছ বোধ হয়, জোয়ারে ভেসে এসেছিল। পানি নেমে গেছে, মাছটা পানির অভাবে আর রোদের কারণে চুপসে গেছে। আপু পাশে একটা পস্নাস্টিকের কন্টেইনার দেখতে পেয়ে সেটাতে মাছটা নিয়ে ছেড়ে দিল পানিতে। সজারুর মতো কাঁটাওয়ালা বলের মতো মাছটা এক সময় ভেসে দূরে চলে গেল। দ্বীপ ঘুরে দেখার সময় এরকম আরও কয়েকটা মৃত মাছ দেখেছি। বুঝলাম, ওখানে রোজই ঘটে এসব। ছেঁড়াদ্বীপ ঘুরে মাত্র একটা দোকানই দেখতে পেলাম। সেটার অবস্থা সেন্টমার্টিনের পুরো উল্টো; মাছের টিকিটিও দেখলাম না। ডিমভাজি আর নানাধরনের ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম সেখানেই। জিজ্ঞেস করলে দোকানের একটা ছেলে জানাল, দ্বীপটার তিনটা অংশ। আর তার একদম দক্ষিণ দিকটার নাম দারুচিনি দ্বীপ! আমার ধারণা ছিল, সেন্টমার্টিন মানেই হচ্ছে দারুচিনি দ্বীপ। কিন্তু সেন্টমার্টিনে যে সত্যি সত্যি 'দারুচিনি দ্বীপ' নামে একটা আলাদা জায়গা আছে, সেটা কি আর আমি ভেবেছিলাম? তাই ব্যাপারটা জানা মাত্রই ছুটলাম সত্যিকারের দারুচিনি দ্বীপ দেখতে। কেয়া গাছের আধিক্যই বেশি। এক জায়গায় কাঠ-কয়লা দেখে অনুমান করলাম, ক্যাম্পফায়ার করা হয়েছিল। প্রবাল,গাঢ় নীল পানি দেখে আর ঝিনুক কুড়িয়ে বিকেল প্রায় পার করে দিলাম। অতঃপর এক ঘণ্টার জায়গায় ছয় ঘণ্টা ঘুরে স্পিডবোটে করে ফিরে এলাম রিসোর্টের দিকে। নারিকেল জিঞ্জিরায় যাব আর নারিকেল গাছ না দেখেই চলে আসব তা কী হয়? ভ্যানে করে লোকালয়ের মধ্য দিয়ে নারিকেলবাড়ীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। কী দেখতে চলেছি তা অবশ্য অনুমিতই ছিল। দ্বীপের অন্য কোথাও নারিকেল গাছের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য না করলেও নারিকেলবাড়ীতে দেখলাম অনেক নারিকেল গাছ। সময় ছিল কম, সেদিন দুপুরেই ফিরতে হবে, তাই ঘোরাঘুরি হয়ে গেলে ডাবের পানি খেয়ে টুকটাক কেনাকাটায় মনোযোগ দিলাম।