রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শুভ জন্মদিন প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আরাফাত শাহীন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করলাম, তখন স্বভাবতই আমার ভেতর অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করল। আমার মনে হলো, দেশের অন্যতম একটি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের অংশ হতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়া প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই এমন মনোভাব পোষণ করেন। ৬ জুলাই ২০১৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজের নামটি জড়িত করতে পেরে আমি গর্ব অনুভব করি। এমনিতে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য খুব বেশি প্রতিষ্ঠান নেই, যারা বহির্বিশ্বের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে নিজের সুনামকে অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে। শিক্ষা, গবেষণা এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে আমাদের গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই আমাদের এই অঞ্চল শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের একচোখা নীতির ফলে শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। কোনো শাসকই আমাদের শিক্ষার দিকে তেমন একটা নজর দেননি। ফলে আমাদের এই অঞ্চলে দারিদ্র্য এবং কুসংস্কার জেঁকে বসেছিল ভয়ঙ্করভাবে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এবং অবহেলিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি ওঠে। সেই মোতাবেক ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক একটা চায়নি পশ্চিম বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীমহল। বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে না কিছুতেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসের একটি বিরাট অংশে পরিণত হয়েছে ইতোমধ্যে। ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। ফলে ভাষা আন্দোলনের যে মৌলিক চেতনা তা এখানে পাওয়া যাবে পুরোপুরি। বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের যে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা, সেখানেও অসামান্য অবদান রেখেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সচেতন ছাত্ররা জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি শাসকরা পরাজয় নিশ্চিত জেনে এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার যে নীলনকশা এঁটেছিল তাতে জীবন দিতে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ূমসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের। শুধু আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেই নয়, '৬৯ সালে যখন স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের আপামর জনসাধারণ ফুঁসে উঠেছিল, তখন তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালাতে উদ্যত হয়েছিল সরকারের পোষা বাহিনী। শিক্ষার্থীরাও উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। এ সময় শিক্ষার্থী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান রসায়ন বিভাগের শিক্ষক এবং তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। সেনাবাহিনী তার বুকে গুলি চালিয়ে দেয়। ড. জোহা লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। স্বৈরাচারীর পতন হয় আর ড. জোহা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি লালন করার পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অসামান্য দৃষ্টিনন্দন একটি ক্যাম্পাস। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে আমার কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে সবার চেয়ে সেরা বলে মনে হয়। অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ান টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায় নির্মিত এই ক্যাম্পাসটি সহজেই মন কেড়ে নেবে যে কোনো দর্শনার্থীর। ভাবলে অবাক হতে হয় প্রতিবছর দেশের নানান প্রান্ত হতে অসংখ্য মানুষ শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসে। প্যারিস রোডের নান্দনিক সৌন্দর্য এবং এর দুই পাশ দিয়ে আকাশছোঁয়া গগনশিরীষ গাছগুলো মোহিত করে রাখে বহুক্ষণ। মনে হয়, অনন্তকাল ধরে যেন এখানে হেঁটে বেড়ানো যাবে; কোনো ক্লান্তি এসে ভর করবে না। এই প্যারিস রোডে এত বছর ধরে কত গল্পই না রচিত হয়েছে! প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই হাতের ডানদিকে পড়ে শাবাশ বাংলাদেশ মাঠ। সেখানে রয়েছে শিল্পী নিতুন কুন্ডুর অসামান্য সৃষ্টি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহক শাবাশ বাংলাদেশ ভাস্কর্য। প্রশাসন ভবনের সামনেই চোখে পড়বে ড. শামসুজ্জোহার সমাধি। প্রশাসন ভবনটিও নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। ৭টি বিভাগ, ১৫৬ জন ছাত্র এবং ৫ জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ রয়েছে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট, ৯টি অনুষদ এবং ৫৭টি বিভাগ। প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করার জন্য রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন শিক্ষক। ১৭টি আবাসিক হল থাকলেও দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানেও আবাসন সংকট রয়ে গেছে। ৭৫৩ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা এবং গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ প্রদান করার জন্য রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল এবং ইনডোর গেমসের জন্য ইনডোর স্টেডিয়াম। শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করার জন্য প্রতিটি বিভাগে সেমিনার লাইব্রেরি থাকার পাশাপাশি রয়েছে প্রায় চার লাখ বই সংবলিত একটি আধুনিক গ্রন্থাগার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাসহ পেশাজীবনে নানান ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্‌, ড. এনামুল হক, হাসান আজিজুল হক, ড. এবিএম হোসেন, ড. অরুণ কুমার বসাকের মতো প্রতীথযশা মনীষীরা এখানে পাঠদান করেছেন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবাধে বিচরণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করে চলেছেন। বর্তমান সময়েও দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দে পদচারণা করে চলেছেন। হাঁটিহাঁটি পা পা করে ৬৫ বছর পেরিয়ে ৬ জুলাই ২০১৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। নানা প্রতিকূলতা এবং বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে প্রাণের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার পদযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এই পর্যন্ত আসতে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বহু বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এক সময় সদা অস্থিতিশীল অবস্থা পাড়ি দিলেও বর্তমান সময়ে এসে জ্ঞান, গবেষণা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার জন্য বাজেট কম বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছুটা হলেও এই অভিযোগ সত্য বলে মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ণ মনোযোগী হবেন। আমি এটাও বিশ্বাস করি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একদিন তার গৌরবময় পদচারণার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নামকে জ্বলজ্বলে সোনার অক্ষরে ফুটিয়ে তুলবে। শুভ জন্মদিন প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়।