রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের ‘প্যারিস রোড’

হাজারো শিক্ষাথীের্দর গান, গল্প, প্রেম, ভালোবাসা ও নানা আন্দোলন জড়ানো স্মৃতির নাম ‘প্যারিস রোড’। ফ্রান্সের নয়, এটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ‘প্যারিস রোড’। দু’ধারের সুউচ্চ গগণশিরিষ গাছ ও পিচঢালা পথ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। ৫০ বছরের পুরনো এই ‘প্যারিস রোড’ নিয়ে লিখেছেনÑ আতিয়া ইবনাত স্মৃতি ও রাশেদ রিন্টু

প্রকাশ | ০১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভোরে অলসতার ঘুম এবং একই সময়ে প্রকৃতির প্রথম রূপ দেখা; দুটোই দুই রকমের প্রশান্তি। তবে নগরজীবনের এই নানা ব্যস্ততায় প্রকৃতির অপূবর্ লীলা দেখার সময় মেলে কমই। তারপরও মানুষ প্রকৃতিতে মিশতে চায়, হারিয়ে যেতে চায় তার ভালোবাসায়, একটুখানি ভালো থাকার নেশায়। আমরা সেদিন সূযর্ জাগার আগেই খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ি প্রথম কিরণ দেখব বলে। হঁাটতে থাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর মনোরম সুশ্রী পিচঢালা রাস্তা ধরে। এই পিচঢালা রাস্তার সবই এসে মিলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক ‘প্যারিস রোড’ এ এসে। আমরা তখন এই ‘প্যারিস রোড’ দিয়েই হঁাটছি। এ এক অন্য রকম অনুভ‚তি। রাস্তার দুই পাশে সুউচ্চ গগণশিরিষ গাছ; যেন রাস্তার দিন-রাত্রীর প্রহরী। কাÐের অনেকটা উপরে গিয়ে ডালপাল মেলেছে চারপাশে। দু’পাশের গাছের ডালপালা রাস্তার মাঝে শূন্যে আলিঙ্গন হওয়ার নেশায় ব্যকুল। এ যেন প্রকৃতির শরীরী খেলা। গাছের চিরচিরে ঘন পাতা রাস্তায় মেলে ধরেছে এক লম্বা সামিয়ানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট থেকে আবাসিক শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হল পযর্ন্ত এই দৃশ্য চোখে পড়ে। নিমর্ল বাতাসে বৃষ্টির মতো গগনশিরিষ গাছের ছোট ছোট চেরা পাতাগুলো যখন ঝরে পড়ে তখন মনে হয়, এ যেন পাতার বৃষ্টিÑ যে বৃষ্টি দু’হাতে কুড়ানো যায়। ততক্ষণে সূযর্মামা উঁকি দিতে শুরু করেছে। রক্তাক্ত লাল সূযের্র রশ্মি গাছের ডাল ভেদ করে অল্প অল্প করে পড়ছে রাস্তায়, আমাদের গায়ে। সূযের্র আলো আর পাতার ছোট ছোট ছায়া পিচঢালা রাস্তায় যেন এঁকে দিচ্ছে প্রকৃতির নানা রূপ, নানা সৃষ্টি। কেবল সকালের সূযর্ নয়, সূযর্ পূবর্ থেকে পশ্চিমে যাওয়া, কিংবা সন্ধ্যার পর থেকে সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এই রাস্তা সাজে বাহারি রূপে। শুধু তা-ই নয়, একেক ঋতুতে এই রাস্তার দৃশ্য পাল্টে যায় বারে বারে। বসন্তের ঝরা পাতার বৃষ্টি, বষার্য় পাতা চুঁইয়ে পড়া ফেঁাটা ফেঁাটা বৃষ্টি জল কিংবা শীতের সকালে কুয়াশা মোড়ানো রাস্তাটি সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়। বৃষ্টির দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্রা নেচে-গেছে, হৈ-হুল্লোড়, ছুটাছুটি করে নিজেদের ভিজিয়ে নিতে এখনো বেছে নেয় এই প্যারিস রোডকেই। এই রাস্তা কারোর জীবনের ভালোবাসার সূচনা, কারো জীবনের সফলতার স্মৃতি হয়ে থাকা ছবির ফ্রেম। এই রাস্তাকে ঘিরে এখানকার পড়–য়া ছাত্রদেরও গবের্র শেষ নেই। গলা ফাটিয়ে অন্যদের শোনায় ‘এমন সৌন্দযের্র প্রতিমা ‘প্যারিস রোড’ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।’ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্ নয়, প্রতিবছর প্রচুর দশর্নাথীর্ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে, কেবল এই প্যারিস রোডে হঁাটবে বলে! প্যারিস রোডর্ সম্পকের্ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষাথীর্ হিরু মোহাম্মদ মন্তব্য করেন এভাবে, এ সেই রাস্তা যেখানে প্রিয়জনের হাতের আঙুল ধরে হঁাটলে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে স্বণাির্ল কোনো অতীত, গম্ভীর মনে জেগে ওঠে প্রেম, নিবার্ক শ্রোতা গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে গান। যেখানে বন্ধুদের সাথে হঁাটলে মনে হয়, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়/ তবে কেমন হতো ...।’ যেখানে নতুনেরা আসার পর বলে, ‘আবার কবে আসবো?’ এটা সেই রাস্তা যার পিচঢালা রাস্তা ধারণ করে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের প্রতিকৃতি। মন শুধু এটাই চাই, ‘চিরজীবী হোক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড।’ আমাদের মনে কৌত‚হল জাগে, এই রাস্তাটির নাম প্যারিস রোড কেন? একটু খেঁাজ নিয়ে জানতে পারি, হাজারো স্মৃতি বয়ে বেড়ানো এই রাস্তাটির নামকরণে আছে ছোট একটি ইতিহাস। ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও মনোরোম করে তোলার জন্য তৎকালীন উপাচাযর্ এম শামসুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেন। তিনি এ দায়িত্ব দেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগকে। বিস্তারিত খেঁাজ নিতে সম্মুখীন হই বতর্মান উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ নুরুল আমিনের। তার ভাষ্য মতে, ‘উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী মো. ইউনুস পকিস্তানের লাহোর থেকে বিমানযোগে এই গাছগুলো ঢাকায় নিয়ে আসেন। গাছগুলো মূলত বিদেশি; এর নাম অষনরমরধ জরপযধৎফরধহধ (বাংলায় গগণশিরিষ)। অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বে লাগানো হয় এই গাছগুলো। তবে এ গাছগুলো লাগানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূণর্ ভ‚মিকা পালন করে তৎকালীন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. মোজাহেদ হোসেন ও অধ্যাপক এটিএম নাদেরুজ্জামান। গাছগুলো রোপণের কিছু দিনের মধ্যেই সবার নজর কাড়তে শুরু করে।’ কিন্তু এ তো গেল এই গাছগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার গল্প; কিন্তু এই রাস্তার নাম ‘প্যারিস রোড’ হলো কেমন করে? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক নুরুল আমিন, ‘আসলে প্রথম দিকে এর নাম প্যারিস রোড ছিল না। নামের প্রচলনটা মূলত শুরু হয় ৮০’র দশকের পর থেকে। আমরা তখন সিনেমাহলে গিয়ে রোড টু সোয়াদ, রোড টু প্যারিস নামের চলচ্চিত্রগুলো বন্ধুরা মিলে খুব মজা করে দেখতাম। সেখানে দেখতাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই রাস্তার মতো ওই চলচ্চিত্রগুলোতেও চওড়া আর দু’ধারে গাছে ঢাকা রাস্তা। যেখান থেকে আমাদের মনে ধারণার সঞ্চার হয়, এই রাস্তার সঙ্গে প্যারিসের এই রাস্তার সঙ্গে মিল আছে। তারপর থেকেই এই রাস্তার নাম প্যারিস রোড হিসেবে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যেই নামের ভার গৌরবের সাখে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে দু’ধারের গগনশিরিষ গাছ এবং পিচঢালা রাস্তাটি।’ তবে প্যারিস রোডের দু’পাশঠাসা গগণশিরিষ গাছের দৃশ্যের কিছুটা বিপযর্য় ঘটেছে গত কয়েক বছর ধরে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুযোের্গ বেশকিছু গাছ ভেঙে পড়ে; বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্পক্ষও নানা অযুহাতে বিভিন্ন সময় গাছ কেটে ফেলেছে। ফলে ঘন আটা পাতার শামিয়ানায় কয়েক জায়গা ছিঁড়ে পড়েছে। তবে সাবির্ক বিপযর্য় উৎরিয়ে প্যারিস রোডের সৌন্দযর্ অক্ষুণœ থাকবে এমনটাই আশা করে শিক্ষাথীর্রা। তারা বলেন, এই প্যারিস রোড আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। প্যারিস রোড বেঁচে থাকবে অন্ততকাল, আমাদের মনে-প্রাণে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে।’