বিদায় বেলায় রঙের খেলায়

বিদায় বেলায় প্রতিটি শিক্ষাগুরুর বক্তব্য শুনে নিজেদের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিটি শিক্ষার্থী আজ মনের গভীর থেকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে এসব শিক্ষাগুরুর কাছে তাদের সব ভুলত্রম্নটির জন্য ক্ষমার চাহনীতে তাকিয়ে ছিল। উপস্থিতি সব শিক্ষকরাও যেন তাদের চাহনী বুঝতে পেরে আবেগময় হয়ে বড়ই দুষ্ঠু, বাউন্ডুলে, অনেক সময় কথার বিপরীতে চলা এসব মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে দুয়েক ফোঁটা জল বিসর্জন করছিল আর আশীর্বাদ করে বলছিল, তোরা অনেক বড় হ।

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বিদায়ী শিক্ষার্থীদেরর্ যাগ ডের আয়োজন
অনিক আহমেদ 'মানুষের জীবনের পুরোটা সময় বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত। একটা ধাপ পেরিয়ে আরেকটা ধাপে উঠতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। প্রতিটা ধাপের কষ্টগুলোকে অসহ্য মনে হয়, তবুও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় সেগুলোকে মাড়িয়ে সামনের পথে এগিয়ে চলতে হয়। একজন শিক্ষার্থীর জীবনের শুরুর বাস্তবতা পড়ালেখার মাধ্যমে শুরু হয়। স্কুল-কলেজ শেষে যখন একজন শিক্ষার্থী ভার্সিটি লাইফে প্রবেশ করে, তখনই মূলত তার জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। সুন্দর একটি ভবিষ্যতের আশায় চিন্তামগ্ন প্রতিটি শিক্ষার্থীর দেখতে দেখতে হারিয়ে যায় লাইফের অন্যতম সেরা সময়গুলো। যখন হুঁশ ফেরে তখন যেন গোধূলিলগ্ন, চাইলেও দিনের আলোকে তখন আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না।' - আবেগময় কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের বিদায়ী শিক্ষার্থী মাহতাবুর রহমান সবুজ। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ২০তম ব্যাচ তথা বিদায়ী শিক্ষার্থীদেরর্ যাগ ডের আয়োজন করা হয়। দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখতে আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে শোভা পাচ্ছিল ব্যানার, রঙিনভাবে সাজিয়ে তোলা হয় সিএসই বিভাগকে। চার বছর আগে যেসব অচেনা মুখ বুকের মধ্যে লালিত স্বপ্ন নিয়ে ক্যাম্পাসে আগমন করেছিল, সময়ের নিষ্ঠুর বাস্তবতায় আজ তারা বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। ক্যাম্পাসের পথচলায় সর্বদা অনুপ্রেরণাদায়ী বড় ভাইদের বিদায় দিতে জুনিয়রদের মধ্যেও যেন অব্যক্ত কষ্ট ফুটে উঠছিল। র্ যাগ ডের প্রথম পর্বে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, বিভাগীয় প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষকরা দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। একসময় ক্লাসে এসব শিক্ষকের লেকচার শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে ওঠা প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে আজ তাদের বক্তব্য যেন বড়ই শ্রম্নতিমধুর লাগছিল। তারা যেন খুব করে চাইছিল, এক সময়ের বিরক্তিময় এসব মুখ থেকে আরও কিছু শ্রম্নতিমধুর বাণী শুনতে। কেননা আজকের পর থেকে চার বছরের পরিচিত এসব মুখগুলোর দেখা যে আর সচরাচর মিলবে না। তাই তো বিদায় বেলায় প্রতিটি শিক্ষাগুরুর বক্তব্য শুনে নিজেদের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিটি শিক্ষার্থী আজ মনের গভীর থেকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে এসব শিক্ষাগুরুর কাছে তাদের সব ভুলত্রম্নটির জন্য ক্ষমার চাহনীতে তাকিয়ে ছিল। উপস্থিতি সব শিক্ষকরাও যেন তাদের চাহনী বুঝতে পেরে আবেগময় হয়ে বড়ই দুষ্ঠু, বাউন্ডুলে, অনেক সময় কথার বিপরীতে চলা এসব মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে দুয়েক ফোঁটা জল বিসর্জন করছিল আর আশীর্বাদ করে বলছিল, তোরা অনেক বড় হ। ভালো সময় নাকি দ্রম্নত ফুরিয়ে যায়- অলিখিত এই সত্যকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অল্প সময়েই যেন দুপুর গড়িয়ে পড়ল। এবার শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে ক্যাম্পাসে নিজেদের শেষ দিনটাকে উদযাপনে মেতে ওঠে। একে অন্যকে আবির মাখিয়ে দেয়া, বেসুরো কণ্ঠে গলা ফাটিয়ে যার যার মতো গান গাওয়া, উরাধুরা নাচ সবই যেন সবার মনে অন্যরকম এক প্রশান্তির সৃষ্টি করছিল। প্রত্যেকের টি-শার্টে বন্ধুদের মার্কারের কালিতে নানা ধরনের লেখা, আঁকিবুঁকি সবই যেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছিল। গোধূলিলগ্নে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বিদায়ী শিক্ষার্থী হোসাইনুল আরেফিন সেতু বলেন, চার বছর আগে যখন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি তখন বুকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু সময় এত দ্রম্নতই শেষ হয়ে গেল যে বুকের মধ্যে লালিত স্বপ্নের কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি জানি না। তবে আমার পথচলার বড় অংশজুড়ে থাকা এই ক্যাম্পাসকে নিজের অজান্তেই বড় ভালোবেসে ফেলেছি। বার বার ফিরে পেতে চাইছে দিনগুলো কিন্তু সময় কত নিষ্ঠুর আচরণ করে আমাদের সঙ্গে, আজকের দিন না দেখলে হয়তো উপলব্ধি করতে পারতাম না। খুব বেশি বড় নয়; কিন্তু ৩৪ একরের ছোট্ট ক্যাম্পাস হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ার মাধ্যম। ক্যাম্পাস যাদের পদচারণায় সর্বদা মুখরিত থাকে, তাদের দলে সিএসই ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও দীর্ঘ সময় ধরে ছিল। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, বাদামতলা, পিঠাঘর, ফুসকা চত্বর, মিডিয়া কর্নার, বকুলতলা, ট্রান্সপোর্ট ইয়ার্ডসহ ক্যাম্পাসের সব স্থানে সর্বদা বিচরণ ছিল তাদের। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মানুষের সঙ্গেও তাদের ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তারাও আজ এসব শিক্ষার্থীর বিদায়ে অশ্রম্নসিক্ত হয়ে পড়ছিল, সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্যাম্পাসের প্রতিটা ইট, বালু, পাথরের রাশভারী কান্না। পুরো ক্যাম্পাসের কান্না আকাশ-বাতাসকে তুমুলভাবে আলোড়িত করে তুলছিল। তাই তো বিদায়লগ্নে অনাবৃষ্টির আকাশও যেন তাদের বিদায়ে যোগ দেয় এক পশলা বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে। গোধূলিলগ্নে এই বৃষ্টি বিদায় আয়োজনকে অন্য এক রূপদান করতে সক্ষম হয়। উপস্থিত বিদায়ী শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে থাকে। তবে যখন বেলা শেষের পথে তখন একে অন্যের চোখের দিকে যেন তাকানো যাচ্ছিল না। অনেকেই অতি আবেগময় হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। সবাই একে অন্যকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে যখন বাড়ির পথে সবাই রওনা হচ্ছিল, পেছন থেকে পুরো ক্যাম্পাস অদ্ভুত এক নীরবতায় স্তব্দ হয়ে ছিল। আর মন থেকে যেন তাদের আশীর্বাদ করে বলছিল, 'এগিয়ে যাও স্বপ্নের পথে, পূরণ করো নিজের চাওয়া, পিতামাতার চাওয়া সর্বোপরি দেশের চাওয়া।'