ই স লা মী বি শ্ব বি দ্যা ল য়

সাগরকন্যার আঁচলতলে

সাগরকন্যার টান আমাদের শুরু থেকেই উচ্ছ্বসিত করে তুলছিল। সিনেমায় দেখা ঢেউয়ের গর্জন আর আঁচড়ে পড়া জলের দৃশ্য কীভাবে কাছ থেকে উপভোগ করব; সাগরের নোনাজল পানি কীভাবে গায়ে মাখব; কীভাবে সাঁতার কেটে ভেসে বেড়াব; উত্তাল শুভ্র ঢেউয়ের সঙ্গে কীভাবে ছবি তুলব সবই যেন মনের কোণে অঙ্কন হচ্ছিল আপন মনে

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
অনি আতিকুর রহমান ইবি এবারও ভেস্তে যাচ্ছিল। কেউই বিশ্বাস করতে পারোনি যে অবশেষে আমাদের শিক্ষাসফরটি হয়েই যাবে। তা নাহলে গত সাড়ে তিন বছরে যা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তা মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই বাস্তবায়ন হয়! বলে রাখি, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আমরা। প্রথমবর্ষ থেকে চতুর্থবর্ষ পর্যন্ত এটাই আমাদের প্রথম টু্যর। তাই উদ্দীপনাও স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি। টু্যরের শুরুটা এভাবে, রাশেদ স্যার আবার বিভাগের টু্যর কমিটিতে দায়িত্ব পেলেন। অতঃপর খুশির সংবাদটি আমাদের ক্লাসে এসে জানালেন। ভাবলাম, এবারই শেষমেশ একটা সুযোগ নেয়া যায়। যেই কথা, সেই কাজ। বিষয়টি জানাতেই তিনি আমাদের সাহস দিলেন। পরে রেজাউল স্যারের সঙ্গে আলাপ করলাম। এসে যোগ দিলেন মনজুর স্যারও। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আয়োজন। ক্লাসে এসে স্যাররা শিক্ষাসফরের বিষয়টি বলতেই বন্ধুরা রাজি হয়ে গেল। চার বছরের খরা কাটাতে রাজি না হয়ে উপায় কি! যাই হোক, তারিখ নির্ধারণ করে আমরা ঘুরে এলাম 'লাল কাঁকড়া' আর 'সাগরকন্যার দেশ' কুয়াকাটায়। শিক্ষাসফর মূলত শিক্ষার উদ্দেশ্যে সফর বা যাত্রা। কিন্তু আমাদের সফরের শিক্ষাটি যেন শুরু গেল যাত্রার শুরুতেই। স্যাররা কুষ্টিয়া থেকে গাড়ি আর টেলিফোনে হোটেল ম্যানেজ করে বাকি দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন ছাত্রদের ওপর। দুর্ভাগ্যক্রমে বড় দায়িত্বটা আমার কাঁধেই পড়েছিল। তাই ফন্দি আটলাম; সবাইকে কীভাবে কাজের সঙ্গে জড়ানো যায়। দুষ্টামি করেই ছোট ছোট কয়েকটি কমিটি করলাম। আর তাতে একে একে দায়িত্ব দিলাম সবচেয়ে চুপচাপ আর সবচেয়ে চঞ্চল বন্ধুদের। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম তাদের এক একজনের কাজের দক্ষতা। যাই হোক, কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে ভাড়া করা একটা বড় সড় বাসে চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো বেলা ১২টার দিকে। চেয়ারম্যান স্যার রবীন্দ্র-নজরুল অনুষদ ভবনের সামনে এসে গাড়িতে আমাদের শুভাশীষ জানিয়ে বিদায় দিলেন। লটারিতে আসন বণ্টন করে শুরু হলো গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা। সাগরকন্যার টান আমাদের শুরু থেকেই উচ্ছ্বসিত করে তুলছিল। সিনেমায় দেখা ঢেউয়ের গর্জন আর আঁচড়ে পড়া জলের দৃশ্য কীভাবে কাছ থেকে উপভোগ করব; সাগরের নোনাজল পানি কীভাবে গায়ে মাখবো; কীভাবে সাঁতার কেটে ভেসে বেড়াবো; উত্তাল শুভ্র ঢেউয়ের সঙ্গে কীভাবে ছবি তুলব সবই যেন মনের কোণে অঙ্কন হচ্ছিল আপন মনে। ফুরফুরে উৎসুক মনে আসন্ন গ্রীষ্মের আলো-বাতাস মাড়িয়ে চলতে থাকে বাংলা পরিবারকে বহন করা বাসটি। বাসচালক সেকান্দার মামা আর তার সহকারী আব্দুল আলিম আমাদের পথিমধ্যে পড়া দর্শনীয় স্থানগুলো একঝলক করে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন। মিহি কালো রাজপথে ক্ষিপ্র বেগে চলতে চলতে আমরা পার করছিলাম আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তায় সারি সারি গাছ, বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ, ইট পাথরের ভবন আর গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের দলা। গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে একে একে আমরা পিছনে ফেলতে থাকলাম ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর আর বরিশাল শহর। সাহিত্যের ছাত্রদের নিয়ে একটি মিথ প্রচলিত আছে, তারা নাকি রসিক আর রোমান্টিক হয়। আসলে হয় বৈকি! সারা রাস্তায় চলতে থাকল আমাদের হৈ-হুলেস্নাড়। গান কবিতা আর নাচে মেতে ছিলাম আমরা। প্রায় দশ ঘণ্টার জার্নি শেষে যখন আমরা কুয়াকাটা গিয়ে পৌঁছালাম; তখন রাত ঠিক ১১টা। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও ঠিক করলাম রাতের সমুদ্র দেখবো। বাস থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে হোটেলে ব্যাগ রেখে দৌড়ে গেলাম বিচে। আহা! সে কী আনন্দ! অন্যরকম এক অনুভূতি। রাতের সমুদ্র দর্শন আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দূর থেকে ঢেউগুলো সশব্দে এসে আঁচড়ে পড়ছিল কিনারে। ধুয়ে দিচ্ছিল আমাদের পদযুগল। কি অমায়িক দৃশ্য। নিশিথের সমুদ্রবিলাস শেষে হোটেলে ফিরলাম। শুরু হলো রাতের আড্ডা। সারারাত আড্ডা জমিয়ে ভোরেই আবার সূর্যের উদয় দেখার পালা। ক্লান্তশ্রান্ত শরীরে ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি হোটেলচত্বরে মোটরসাইকেল অপেক্ষা করছে। অচেনা জায়গা বলে ছেলেমেয়ের কম্বিনেশন করে উঠে পড়লাম বাইকে। একে একে ঘুরে দেখলাম ছাগলছেঁড়া বাজার, জাতীয় উদ্যান, গঙ্গামতি চর, কাউয়ার চর, লাল কাঁকড়ার চর, ঝাউবন, রাখাইন পলস্নী, বৌদ্ধ মন্দির, মিষ্টি পানির কূপ। দুপুরে হলো সমুদ্রস্নান। শিক্ষক ছাত্রের বেড়া ভেঙে আমরা সবাই তখন হয়ে গেলাম খেলোয়াড়। ফুটবল নিয়ে মেতে উঠলাম অশান্ত সমুদ্রের পানিতে। মুগ্ধ হয়ে ঘুরতে-ফিরতে ঘনিয়ে এলো সময়। এবার ফিরতে হবে। দুই দিনের ভ্রমণেই কুয়াকাটার পটে এঁকে দিয়ে এলাম বাংলা পরিবারের নাম। রেখে ফিরলাম কতশত স্মৃতি। সময় হয়তো আবারও কোনো একদিন আমাদের নিয়ে যাবে সাগরকন্যার আঁচলতলে। কিন্তু সেদিন বন্ধুত্বের মধুমাখা জায়গাটি হয়তো দখল করে নেবে অর্ধাঙ্গ/অর্ধাঙ্গী আর তনয়-তনয়ার স্নেহময় বন্ধনে। সেই যাত্রাটি হবে স্মৃতি শুধু আঁকতেই নয়; স্মৃতি খুঁজে ফিরতেও।