গুরু, শিষ্য ও অভিভাবকের প্রণয়স্থান যখন 'বিদ্যাগুরু'

প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বেলাল হোসেন আমাদের চিন্তা যখন কোনো বিষয়ের একটি পর্যায়ে থেমে যায় তখন তা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। চিন্তাকে নতুন করে আবর্তিত করতে হয়। তখন সেখানেই গড়ে ওঠে নতুন উদ্যম। শুরু হয় নতুন করে পথচলা। এভাবেই একদা কোনো এক সময়ের উদ্যম পরিণত হয় উদ্যোগে। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন নতুন উদ্যোক্তা। ঠিক এরকমভাবেই নতুনরা ধীরে ধীরে জয় করে নেয় পুরনোদের স্থান, উন্নত হতে থাকে পৃথিবী নামক এই গ্রহ। যেখানে প্রাচীনরা হারিয়ে যায় না বরং স্থান করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। সেই ইতিহাসের পাতা হয়ে ওঠে নবীনদের এগিয়ে চলার জ্বালানি শক্তি। বৌদ্ধ বিহারের জ্ঞানচর্চা যখন জগদ্বিখ্যাত তখন সুদূর গ্রিক ও চীন থেকেও হিউয়েন সাঙ ও ফাহিয়েনের মতো পরিব্রাজকরা অতীশ দীপঙ্করের মতো বিজ্ঞ গুরুদের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে আসত। ইতিহাসের এই ধারা থেকেই শিক্ষার জন্য গুরু-শিষ্যে একে অন্যের কাছে আসা এক পুণ্যের কাজে রূপায়িত হয়। ইতিহাসের সে ঘটনার ডিজিটাল পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছে 'বিদ্যাগুরু'। যেখানে বিদ্যার্থীরা খুঁজে নেবে তাদের কাঙ্ক্ষিত গুরু-শিষ্য। অভিভাবকরা পাবেন নিশ্চিত স্বস্তি। বিদ্যাগুরু এমনি একটি ওয়েবভিত্তিক পস্নাটফর্ম হতে হচ্ছে যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তা করার দিন ফুরাবে। গুরু-শিষ্যের বর্তমান জ্ঞানযাত্রায় গুরুর করুণ দশা আবির রাজধানীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তবেই সে শহরে এসে পড়ালেখা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখানে সে গ্রামের মতো পরিশ্রমী কাজ পায় না। কাজেই তাকে টিউশনির জন্য চেষ্টা-তদবির করতে বড়ভাইদের কাছে অনেকদিন ধর্ণা দিতে হয়। অবশেষে বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি টিউশনি যদিও বা পায়। ক্যাম্পাস থেকে তার দূরত্ব হয় ১০ কিলোমিটার। রাজধানী শহরের জ্যাম অতিক্রম করে ছাত্রের কাছে যাওয়া-আসা করতেই তার ৩ ঘণ্টার মতো মহামূল্যবান সময় নষ্ট হয়। এরপরে ২ ঘণ্টা বিদ্যাচর্চা। এভাবেই মাসব্যাপী চললেও মাসের শেষে কাঙ্ক্ষিত সম্মানী পায় না, পেলেও নির্ধারিত সময় থেকে অনেক দেরি হয়ে যায়। এছাড়া অনেক জায়গায় টিউশনি খুঁজতে গেলে একই সঙ্গে নিজের সাবজেক্ট, সম্মানী, অভিভাবকের চাওয়া-পাওয়া সবমিলিয়ে আর সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে ক্যাম্পাস ছুটি হয়ে গেলেও নির্জনে দিনানিপাত করতে হয় শুধু একটি টিউশনির কারণে। এসব চলমান সমস্যার যুগোপযোগী অসাধারণ সমাধান নিয়ে আসছে বিদ্যাগুরু। যার মাধ্যমে চাইলেই দেশের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে পড়ানো সম্ভব হবে। অভিভাবক ও শিষ্যের চাওয়া-পাওয়া শহরে বাবা-মা সন্তানের জন্য চাহিদামতো শিক্ষক পেলেও মানসম্মত পাঠদান, নিয়মানুবর্তিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকে। অন্যদিকে গ্রামের প্রেক্ষাপটে ভালো মানের শিক্ষক পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কারণ এখানে মানসম্মত প্রাইভেট টিউটর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শহরের বাস্তবিক পরিবেশে অভিভাবকরা একজন অচেনা আগন্তুত্মককে নিজের সন্তানের দায়িত্ব দিতে অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অন্যদিকে প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কিংবা বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পরামর্শ ও সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়। বিদ্যাগুরুর বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্রম বিদ্যাগুরুতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অঞ্চলভিত্তিক নয় বরং বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত থাকবে। এসময় শিক্ষক তার পছন্দমতো এবং শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক তাদের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষক খুব সহজেই খুঁজে নিতে পারবে। সম্মানী লেনদেনের নিরাপত্তার জিম্মা থাকবে বিদ্যাগুরু ওয়েব কর্তৃপক্ষের। নির্দিষ্ট পন্থায় তা জমা অথবা উত্তোলন করা যাবে। থাকবে না কোনো ধরনের অবাঞ্চিত ঝুট-ঝামেলা। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, জীবন দক্ষতা, পেশাগত দক্ষতা, প্রতিযোগিতা পরীক্ষাগুলোর প্রস্তুতির সুবিধা যা মান্ধাতা আমলের টিউশনিব্যবস্থায় কল্পনাই করা যায় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আছে যারা টিউশনি করান কিন্তু তাদের থাকে না কোনো ধরনের অফিসিয়াল অভিজ্ঞতার সনদ। যার ফলে চাকরি আবেদনের সময় অনেকেই পড়েন বিড়ম্বনায়। বিদ্যাগুরু এর সুন্দর একটি সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে অভিভাবক ও শিষ্যরা পাচ্ছে দেশের সব খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যয়নরত শিক্ষক। শিক্ষকদের গ্রেডিং করার ফলে একজন শিক্ষকের যোগ্যতা, নৈতিক চরিত্র, আচার-আচরণ, কমিটমেন্ট সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হবে। ফলে অভিভাবকদের সংকটের জায়গাটি আর থাকবে না। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মো. রিয়াজুল করিম। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ২০০৯ সাল থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে প্রতিষ্ঠা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মডেল ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন। তিনি ২০১৬-১৭ সালে, ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বাসাডর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষার ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে ছুটে বেড়ান শহরের ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তিনি ২০১৭ সালে গেস্নাবাল পস্নাটফর্ম বাংলাদেশের সহায়তায় একটি স্টাডিও করেন। যাতে অংশগ্রহণ করে দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল। ২০১৩ সাল থেকে অ্যাডুকেশন পার্লামেন্ট নিয়ে কাজ করছেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে থেকে তাদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করতে বদ্ধপরিকর এ তরুণ নেতা ব্রিটিশ হাইকমিশন কর্তৃক ডিউক অব এডিনবার্গ গোল্ড এওয়ার্ডে ভূষিত হন। বিদ্যাগুরু সম্পর্কে মো. রিয়াজুল করিম জানান, 'মফস্বল থেকে বেড়ে উঠেছি যেখানে ছিল না কোনো ইন্টারনেট কিংবা আদর্শিক মানের শিক্ষক। বর্তমান সরকারের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টায় এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উদ্যোগে ইন্টারনেট সুবিধা অনেক সহজবোধ্য হওয়াই সবার বোঝা সহজ হয়েছে যে শেখার মাধ্যম এখন শুধু বিদ্যালয় আর বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একপক্ষীয় শিক্ষা অনেকাংশেই কোনো কাজে আসে না। সেটা মুখস্থ বিদ্যার মতো অর্থহীন। বিদ্যাগুরু এমন একটি অনলাইন পস্নাটফর্ম, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সব বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শিক্ষকদের কাছ থেকে মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে পারবে। অডিও, ভিডিও এবং অত্যাধুনিক ডিজিটাল বোর্ডের মাধ্যমে পাঠদান প্রক্রিয়ায় আপনার কখনোই মনেই হবে না শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক আসলে অনলাইনে দূরে বসে পাঠ কার্যক্রম সম্পন্ন করছে।' বিদ্যাগুরুর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, 'বহুদিন থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি। ভবিষ্যতে মানসম্পন্ন আধুনিক চিন্তার ফসল হিসেবে শহরে এবং গ্রামে বিদ্যাগুরু শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলব। যা শিক্ষার্থীদের নিজের ইচ্ছামতো শেখার সুযোগ করে দেবে। শিক্ষার্থীরা কাজ করবে নব সৃষ্টির লক্ষ্যে, এপস্নাসের প্রত্যাশায় না। বিদ্যাগুরু ব্যবহার এতটাই সহজ যে, তৃতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীও অনায়েসেই তা ব্যবহার করতে পারবে। বিদ্যাগুরুর অসাধারণ নতুন নতুন আপডেট ও ফিচার নিয়ে কাজ করছেন। প্রত্যাশা নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে পাঠাও কিংবা টেন মিনিটস স্কুল ইতোমধ্যে যে অবদান রেখেছে তার চেয়ে বিদ্যাগুরুর অবদান কোনো অংশে কম হবে বলে মনে হয় না। বিদ্যাগুরু হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতের প্রকৃত স্বাধীন এবং পার্সোনালাইজড শিক্ষা কেন্দ্র যেখানে প্রাথমিকভাবে এক লাখ শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীসহ শিক্ষিত গৃহিণীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।' সর্বোপরি বলা যায় বিদ্যাগুরু এমন একটি মাধ্যম হতে যাচ্ছে যেখানে আবিরের মতো একটি টিউশনি করার জন্য কোনো ধরনের বিচ্ছেদ ও বিড়ম্বনা সইতে হবে না।