বা ং লা দে শ কৃ ষি বি শ্ব বি দ্যা ল য়

মেঘের রাজ্য মেঘালয়ে আমরা

মেঘের সঙ্গে খেলা করার স্বপ্ন কার না থাকে? তবে মেঘের সঙ্গে খেলা করাতো এত সহজ নয়। মেঘের সঙ্গে খেলা করতে হলে যেতে হবে মেঘের রাজ্যে। ভারতের মেঘালয় রাজ্য তেমনই এক মেঘের রাজ্য। পাহাড়ের কোলে মেঘের নিত্যখেলা আর জলপ্রপাতের গর্জনের সঙ্গে অপরূপা মেঘালয় ঘুরতে কে না চায়? আর মেঘালয় রাজ্যে ঘুরে আসা একদল সৌন্দর্যপ্রেমী ভ্রমণপিপাসুর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন - নাবিল তাহমিদ রুশদ ও কৃষিবিদ হাতেম আলী

প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভারতের সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে যে রাজ্যগুলো রয়েছে তার মধ্যে মেঘালয় অন্যতম। মেঘা অর্থ মেঘ আর আলয় অর্থ নিবাস অর্থাৎ মেঘালয় মানে মেঘের নিবাস। এটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব পাহাড়ে ঘেরা একটি রাজ্য। আমরা সিলেট, ময়মনসিংহ থেকে ভারতে যে বড় বড় পাহাড়গুলো দেখতে পাই কিন্তু যেতে পারি না সেগুলো সবই মেঘালয়ের। সিলেট, ময়মনসিংহ ঘুরতে গিয়ে ওই পাহাড়গুলো দেখে আফসোস হতো খুব। ইচ্ছে হতো ওই পাহাড়ে উঠে মেঘকে ছোঁয়ার। সেই ইচ্ছাকে পূরণ করতেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পাড়ি জমিয়েছিলাম মেঘালয়ের মেঘের রাজ্যে। মেঘালয় যাওয়ার জন্য আগস্ট মাস খুবই ভালো সময়। তাই আগস্টের মাঝামাঝি এক রাতে আমি (কৃষিবিদ হাতেম আলী) ও আমার ৩ বন্ধু (মানী, পুলক ও ইমরান) ঢাকা থেকে রওনা হলাম সিলেটের উদ্দেশে। সকাল ৬টায় সিলেটে পৌঁছলাম। পরে সেখান থেকে তামাবিল বর্ডার হয়ে মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডারে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে ডাউকি বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করি। ডাউকি বাজারে যাওয়ার সময় বড় বড় পাহাড়গুলো স্মরণ করিয়ে দিল যে আমরা মেঘালয়ে চলে এসেছি। সেই সময় মনের মধ্যে অন্যরকম এক শিহরণ কাজ করছিল। সকালের হালকা নাস্তা শেষে বাংলা টাকাকে ইন্ডিয়ান রূপিতে পরিণত করে একটা গাড়ি ঠিক করে রওনা হলাম আমাদের প্রথম স্পট 'লিভিং রুট' ব্রিজ দেখার জন্য। যাওয়ার সময় মেঘালয়ের মেঘ যেন বিনা আমন্ত্রণে এসে আমাদের ছোঁয়া দিয়ে গেল। পরিচয়ের শুরু হলো মেঘালয়ের মেঘেদের সঙ্গে। তারপর চলে এলাম 'লিভিং রুট' ব্রিজে। দুটি জীবন্ত গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি এই ব্রিজের নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনা। সেই ঝরনার পানিতে কিছুক্ষণ খেলা করে চলে এলাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম 'মাওলিনংয়ে'। পূর্ব খাসি পাহাড়ের এ গ্রামকে বলা হয় 'ইশ্বরের নিজস্ব বাগান'। এই গ্রামে বাঁশের তৈরি একটা ঘর আছে যাকে বলা হয় বাংলাদেশের ভিউ। এখান থেকে বাংলাদেশের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এরপর যাত্রা করলাম মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের উদ্দেশে। রাত ৮টায় আমরা সেখানে পৌঁছলাম। সেখানে অপেক্ষায় ছিল আমাদের আরেক বন্ধু আকিব ও তার ছোট ভাই অভি। তারা আগেই কলকাতা হয়ে শিলং গিয়েছিল। রাত যাপন শেষে সকাল ৬টার মধ্যে বের হয়ে গেলাম শিলংযের সৌন্দর্য দেখার জন্য। প্রথমে গেলাম উমিয়াম লেকে। স্থানীয় ভাষায় একে বড় পানি বলা হয়। পানির উপরে সকালের আকাশের বিম্ব আর পাহাড়ের উপর সাদা মেঘ সব মিলিয়ে এক অপূর্ব জায়গা এটি। পরের যাত্রা শুরু হলো ডন ভস্কো মিউজিয়াম দেখার জন্য। একটি মিউজিয়াম যে কতটা আধুনিক এবং তথ্যবহুল হতে পারে তা এটি না দেখলে বোঝাই যেত না। সেভেন সিস্টার্সের ইতিহাস, কৃষ্টি-কালচার সব সুন্দরভাবে সাজানো আছে এখানে। ৭ তলার এই মিউজিয়ামের ছাদে উঠলে পুরো শিলং শহরটাকে দেখা যায়। এক বাঙালি হোটেলে খাবার খেয়ে আমারা চলে গেলাম লাইটলুশে। কিন্তু বৈরি আবহাওয়ার কারণে লাইটলুশের সৌন্দর্য আমাদের আর দেখা হলো না। এতে সবারই একটু মন খারাপ হলো। চলে গেলাম এলিফ্যান্ট ফলস দেখতে। এটি একটি ৩ স্তরের ঝরনা। দেখেই সবার মন আনন্দে ভরে গেল। খাওয়া-দাওয়া শেষে যাত্রা করলাম চেরাপুঞ্জি। মানে বৃষ্টির শহরে। সেখানে গিয়ে আগেই থাকার জন্য একটা হোম স্টে ভাড়া করলাম। এরপর ফ্রেশ হয়ে চেরা বাজারের দিকে। বৃষ্টিস্নাত রাত। আমরা সবাই রেইনকোট পরে চেরা বাজারে ঘুরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ও কেনাকাটা করলাম। তবে এই বৃষ্টি আমাদের দেশের বৃষ্টির মতো না। এতে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। যা শরীরে অন্যরকম পরশ বুলিয়ে দেয়। সকাল ৬টার দিকে আমাদের গাড়ি রওনা হলো চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে। আমরা প্রথমে, চলে গেলাম সেভেন সিস্টার্স ঝরনা দেখতে। কিন্তু ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও আমরা এই ঝরনা দেখতে পারিনি শুধু মেঘের জন্য। ঝরনার পানির কলকল শব্দ শুনেছি কিন্তু না দেখার আফসোস আমাদের মনে পীড়া দিচ্ছিল। দেখতে না পেয়ে আমরা হতাশ হয়ে চলে গেলাম মসমাই গুহা দেখতে। ১৫ মিনিটের ভয়ঙ্কর যাত্রায় গুহা দেখা শেষ করলাম। এরপর চলে গেলাম নোহকালিকাই ঝরনা দেখতে। প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে এখানে না গেলে আমরা বুঝতেই পারতাম না। নোহকালিকাইয়ের সৌন্দর্য দেখে চলে এলাম দাইনথল ঝরনা দেখতে। বিধাতা যেন নিজ হাতে তৈরি করেছে এটি। এটি দেখা শেষ করে চলে এলাম উইসুড়ং ঝরনা দেখতে। তবে এটি দেখতে একটু কষ্ট করতে হয়েছিল। ২০ মিনিট পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে এসে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যে পাহাড়ের নিচে এত সুন্দর ঝরনা থাকতে পারে তা আমাদের কল্পনাতেও আসেনি। উপরে ওঠার সময় সঞ্চিত শক্তি শেষ। শরীর ক্লান্ত হলেও মনতো মানছে না। চোখ বলছে আরো দেখব। 'ওয়াকাবা' দেখতে চলে এলাম। খাসিদের ট্রেডিশনাল ড্রেস পরলাম। এক একজন এক এক যোদ্ধা সাজলাম। এরপর রওনা হলাম ডাউকির উদ্দেশে। এবারের গন্তব্য 'সোনমপোডং'। এটি একটি গ্রাম- যা 'ইমগঠ' নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে এসে ঠিক করলাম নদীর তীরে তাঁবুতে থাকব। নদীর কলতান সুরে মাতাল প্রায় অবস্থা সবার। সকালে ঘুম থেকে উঠে উমগঠের যে সৌন্দর্য দেখলাম তা ছিল বড়ই অদ্ভুত ও মায়াবী। নদীর পানি পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছিল, আর আমরা অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর 'উমগঠ ঝুলন্ত ব্রিজ' দেখে কাংছড়িতে এসে আমরা সবাই ঝরনার পানিতে গোসল করলাম এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করে মেঘালয়ের জার্নি শেষ করলাম। মেঘালয়ের জার্নি শেষ হচ্ছে বলে সবার মনেই একটা চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। তবুও তো ফিরতে হবে আমাদের চিরচেনা নীড়ে। এই কয়দিনের স্মৃতি আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে রবে। তবে আমাদের পাশের অঞ্চল মেঘালয়ের টু্যরিজম সেক্টর অনেক পরিকল্পিত। পরিকল্পনা করে তাদের সবগুলো দশর্নীয় এলাকা সাজানো। আর সেখানকার পরিবেশ অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা করলেই আমাদের দর্শনীয় স্থানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতে পারে। এতে আমাদের পর্যটন সেক্টর আরও উন্নতি সাধন করবে ও আর্থিকভাবে দেশ উপকৃত হবে।