জা হা ঙ্গী র ন গ র বি শ্ব বি দ্যা ল য়

আবাসিক হল: দ্বিতীয় ঠিকানা, দ্বিতীয় পরিবার

অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষ, কিন্তু সেই মানুষ আর পরিবেশ বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, নতুন কাউকে আপন করে নিতে খুব বেশি সময় নেয় না। বন্ধু বা সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কগুলো একবারের এক দেখায় হয়ে যায়। হল থেকে ক্লাস করতে যাওয়াটা রীতিমতো এক মহাযজ্ঞ, ব্যাচের সবাইকে ডেকে একত্রে ক্লাসে যাওয়া হয়, ক্লাস শেষে হলে ফেরার পর্বটাও একই রকম।

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মাহমুদুর রহমান মানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, কত মানুষের কত স্বপ্ন, কত স্মৃতি, যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে এবং সেই স্মৃতির পাতা প্রতিদিন বেড়ে চলছে। শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় ঠিকানা, দ্বিতীয় পরিবার সবই আবাসিক হলকে কেন্দ্র করে। সাবেক ও বর্তমান যারা হলে থেকেছে তাদের কাছে এই হল জীবনের মূল্য কতটুকু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভালো বা খারাপ সময় আবাসিক হলে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত সারাজীবন স্মৃতির পাতায় থেকে যায়। থাকবেই না কেন, কৈশোর পেরিয়ে জীবনের মূল্যবান ছয় সাত বছর কাটানো হয় আবাসিক হলের রুমে। এই রুমকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে কত স্বপ্ন, স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দিয়ে চলে যেতে হয়েছে কতজনকে, আবার নতুন স্বপ্ন নিয়ে সেই রুমেই এসেছে কতজন, একথা আবাসিক হলের ইট পাথর ছাড়া আর কেউ হয়তো বলতে পারবে না। কলেজ জীবনের পর প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন থাকে কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও আবাসিক হলে থাকার। আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ নেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে এবং বাড়ির পর নিজের দ্বিতীয় ঠিকানা হয় মীর মশাররফ হোসেন হল নামক লাল ইটের স্বর্গে। অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষ, কিন্তু সেই মানুষ আর পরিবেশ বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, নতুন কাউকে আপন করে নিতে খুব বেশি সময় নেয় না। বন্ধু বা সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কগুলো একবারের এক দেখায় হয়ে যায়। হল থেকে ক্লাস করতে যাওয়াটা রীতিমতো এক মহাযজ্ঞ, ব্যাচের সবাইকে ডেকে একত্রে ক্লাসে যাওয়া হয়, ক্লাস শেষে হলে ফেরার পর্বটাও একই রকম। হলের রুম বা ছাদ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গানতো নিত্যদিনের ব্যাপার। বন্ধুবান্ধব সুযোগ পেলেই হয়ে যায় পিকনিক বা কোথাও ঘুরতে যাওয়া। রুমমেট বা ক্লাসমেট সিনিয়র-জুনিয়র একজনের বিপদে আরেকজন খুব সহজেই এগিয়ে আসে, এ যেন পরিবার রেখে এসে আরেকটি পরিবার পাওয়া। পরিবারের এক সদস্য যেমন অসুস্থ হলে অন্য সদস্য এগিয়ে আসে হলের সম্পর্কগুলোও ঠিক তেমন। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তেমন একজন আরেকজনকে সাহায্য সহযোগিতা করছে- যা হলে না থাকলে বা না গেলে পাওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আড্ডা জমে জম্পেশ। আড্ডা গান বা প্রিয় দলের খেলা দেখতে পরিবারের সব সদস্য ভিড় করে কমন রুমে। নিজের দেশের খেলা হলে কমন রুম পরিণত হয় মিনি স্টেডিয়ামে। সে আনন্দ উলস্নাস না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য নয়, জিতলে আনন্দ উলস্নাসে ফেটে পড়ে সবাই এক সঙ্গে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, হলের প্রতিটি স্টাফ ও কর্মচারী তারাও কখন যে আপন হয়ে যায় বলা মুশকিল। এ হলে ছাত্র ও কর্মচারী বা দোকানিদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক, কারণ তারাও পরিবারের বড় একটি অংশ। রাতে সবুজ ভাইয়ের ছোট দোকানে মিষ্টি অথবা মশাররফ ভাইয়ের খিচুড়ি কিংবা কাঠফাটা তপ্ত রোদে পিপাসা মেটায় সাহেব ভাইয়ের শরবত অনেকের কাছে সামান্য মনে হলেও মীর মশাররফ হোসেন হলবাসীর কাছে এগুলো ভালোবাসার জায়গা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই লাল ইটের স্বর্গের এক মুক্ত আকাশ ও সকাল বিকেল পাখির কলতানে প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম হয়,প্রন্ধুত্ব হয়, ভালোবাসা হয়, হয় স্বপ্ন বোনা ও স্বপ্ন গড়া আর স্মৃতিগুলো জমা হয় লাল ইটের ভাঁজে ভাঁজে। চতুর্থ বছর পেরিয়ে পঞ্চম বছরে আর হয়তো খুব বেশিদিন এখানে থাকার সুযোগ নেই কিন্তু মনের গহিনে আজীবন থেকে যাবে মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রতিটি মুহূর্ত। অনেকটা নিজের অজান্তেই হলের জীবনকে সবাই আপন করে নেয়। পরিবার আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে থাকলে তাদের কথা মনে পড়া খুব স্বাভাবিক, কিন্তু পরিবারের কথা মনে হলেও পরক্ষণেই হলের পরিবেশ বন্ধু সিনিয়র-জুনিয়র থেকে শুরু করে স্টাফ, দোকানদার বা ক্যান্টিন বয়কেও নিজের দ্বিতীয় পরিবারের অংশ মনে হয়। এখানকার প্রতিটি মানুষের প্রতি মায়া জন্মে, আর এই মায়ার জন্যই পরিবার পরিজন থেকে কয়েকশ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করা সম্ভব হয়। প্রতিটি আবাসিক হলে আনন্দ উলস্নাসে কখন যে জীবনের ছয় সাত বছর কেটে যায় সে কথা কোনো সাবেক যেমন বলতে পারবে না ঠিক তেমনি কোনো বর্তমান শিক্ষার্থীও উপলব্ধি করতে পারে না যে, ক্রমেই তার এই স্বর্গনগরী ছেড়ে দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। এত দ্রম্নত কিভাবে সময় চলে যায় এ রহস্য জানে সম্ভবত শুধুমাত্র আবাসিক হলের চার দেওয়াল, যারা প্রতি নিয়ত দেখছে নতুন পুরানদের আসা যাওয়ার মিছিলে কতগুলো সম্পর্ক ও ভালোবাসা তৈরি হয়, কত নতুন স্বপ্ন চার দেয়ালে বেড়ে ওঠে। আর এভাবে সম্পর্ক ও স্বপ্ন ভাঙাগড়ার মাঝে আবাসিক হল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় ঠিকানা। এখানে বসবাসরত প্রতিটি মানুষ দ্বিতীয় পরিবারের সদস্য।