শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুরের সাধক সুনির্মল

নতুনধারা
  ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মাহফুজ কিশোর

গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সুনির্মল। পুরো নাম সুনির্মল দাস বাপী (২৫)। পেশায় ছোটখাটো একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হলেও মজেছেন সুরের প্রেমে। কাজের অবসরে মাতেন বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে। স্বীয় প্রতিভায় একে একে তৈরি করেছেন প্রায় অর্ধশতাধিক দেশীয় বাদ্যযন্ত্র- যাদের বেশিরভাগই ক্রমশ বিলীন হতে চলেছে বাংলা লোকসঙ্গীতের জগৎ থেকে।

গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার গান্ধিয়াশুর গ্রামে সুনির্মলের বাড়ি। শৈশবে দূর সম্পর্কীয় দাদু কারুশিল্পী বিজয় পান্ডের হাত ধরেই সুনির্মলের হাতেখড়ি হয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজে। দেশীয় লোকসঙ্গীত ও লোকসংস্কৃতিকে মননে ধারণ করে তিনি আপন হাতে তৈরি করেছেন- সুরেলা ম্যাচ বাক্স, শামুক, নারিকেলের পাতা ও বড়শি- বাঁশের মিশ্রণে পাতাবীণ, কাঠের দোতারা, বেহালা, বাঁশের চটা, সানাই, মৃদঙ্গ, রাবণবীণা, শিঙা, ঢাক, কাড়া, খোল, করতাল, সারিন্দা, সরজ, নাকারা, ব্যাঞ্জো, শঙ্খ, খমক, একতারা, খঞ্জনি, কাহন, জলতরঙ্গ, মেরাকাচ, মন্দিরা, চুড়িছেকার, ঝুমুর, ঢোল, তবলা, ডুগডুগি, প্রেমজুড়ি, বীণবাঁশি, মোহন বাঁশিসহ প্রায় পয়ষট্টি প্রকার নানাবিধ যন্ত্র।

বাদ্যযন্ত্রগুলোর একেকটির সুর ও তাল একেক রকম। সামান্য দিয়াশলাই থেকে শুরু করে বাঁশ-বড়শির সুতার তৈরি পাতাবীণ, শামুকের খোলস কিংবা চুড়ি থেকে তৈরি চুড়িছেকার- সবগুলোই দেখতে অসাধারণভাবে আকর্ষণীয়। বাঁশ, কাঠ, বিভিন্ন গাছের পাতা, কান্ড, ডালপালা রয়েছে তার এসব যন্ত্রের নির্মাণসামগ্রীতে। আবহাওয়ার পরিবর্তনে যন্ত্রগুলোর টিউনগত কোনো তারতম্য হয় না। শুধু তৈরি আর সংরক্ষণই নয়, চাহিদা নিয়ে সেগুলো বিক্রয়ের কাজটিও করেন তিনি।

এক সময় আবহমান বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাউলগান, পালাগান, যাত্রাপালা, কবিগানের আসরে যেসব গ্রামীণ বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো। লালন সাঁইজি থেকে শুরু করে শত-সহস্য মরমী সাধক, শিল্পীর গানে ও সুরে সঙ্গ দিয়েছে এসব বাদ্যযন্ত্র। কালের আবর্তে, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে সেগুলো যেন হারিয়ে না যায় সেই চেষ্টাই করছেন সুনির্মল। বাদ্যযন্ত্র তৈরির পাশাপাশি সেগুলো নিয়ে গবেষণাও করছেন তিনি। এসবের বেশিরভাগ যন্ত্রই তিনি বাজাতে পারেন দক্ষতার সঙ্গে। একইসঙ্গে পেশাগতভাবে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হওয়ার সুবাধে খমক, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বেহালা ইত্যাদি যন্ত্রে বৈদু্যতিক সংযোগেরও প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি সফলভাবে। সুর সাধনার পাশাপাশি সমাজসেবক হিসেবেও সুনির্মলের নাম রয়েছে। বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপির গ্রামীণ পর্যায়ের একজন সক্রিয় সদস্য তিনি। নিজ গ্রামে বেকার সমস্যা নিরসনে যুব সমাজকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেওয়াও তার লক্ষ্য।

এ ছাড়াও যুবকদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি গ্রন্থাগার যেখানে বিভিন্ন শিক্ষামূূলক বই সংগ্রহ করে রেখেছেন সুনির্মল। এসবের মাধ্যমে তিনি চান যুবসমাজ যেন মাদক-বেকারত্বে না ডুবে জীবনমুখী হয়। এ লক্ষ্যেই গোপালগঞ্জ জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সুর সংগম, শিল্পকলা একাডেমি, মা শিল্পী সাংস্কৃতিক সংগঠন, লালন একাডেমি গোপালগঞ্জ- ইত্যাদি সংগঠনে একনিষ্ঠভাবে অধ্যবসায় করছেন তিনি।

চার ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সুনির্মলের বাবা সুনীল দাস একজন প্রাথমিক শিক্ষক। পরিবারে অভাব-অনটন থাকলেও স্বপ্নীল সুনির্মলের বাদ্যযন্ত্রের প্রতি নেশা কমেনি একবিন্দুও। বরং প্রতিদিন তিনি নতুন উদ্ভাবনের আশা-সম্ভাবনায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অদম্য সুনির্মলের প্রত্যাশা, কোনো একদিন তিনি সফলতার মুখ দেখবেনই। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের মৌলিক সুর ও লোকসঙ্গীতের প্রাচীন, মোহনীয় ও চিত্তাকর্ষক রূপটি ফিরিয়ে আনাই যেন সুনির্মলের একমাত্র ব্রত ও পথ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79024 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1