তারুণ্যের বিজয় ভাবনা

বিজয়ের মাসে সাত কোটি বাঙালিকে বেছে নিতে হয়েছিল সংগ্রামের পথ, যে লাল-সবুজ পতাকা অর্জিত হয়েছে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে, যে মানচিত্রের জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে দুই লাখ মা-বোনকে, সেই বিজয়ের মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব তরুণদের। একটি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হবে তরুণদেরই। বিজয়ের এত বছর পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে কী ভাবছেন তারা। দেশকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন কী। তরুণদের বিজয় ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন- অনিক আহমেদ

প্রকাশ | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করা বাঙালি জাতি বিজয়ী হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাই আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ব করে বলতে পারি, 'আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে জানি'। বিজয়ের অনুভূতি সবসময়ের আনন্দের হয়। তবে আনন্দের পাশাপাশি বেদনাও কম নয়। কেননা, এই বিজয় এসেছে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়। এ বিজয় অগণিত নারীর সম্ভ্রম হারানোর ফল। আমরা সেই বীর শহিদদের বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগের কথা কোনোদিন ভুলব না। ভুলতে পারব না নির্যাতিত মা-বোনদের আত্মত্যাগ। যতদিন এই দেশ থাকবে, ততদিন গভীর শ্রদ্ধায় বাঙালি জাতি তাদের স্মরণ করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরাই প্রথম জাতি, যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের তেমন প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী ছিল ]না। আমাদের নিরস্ত্র মানুষরা সংগঠিত হয়ে যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আগে আমাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছেনি বলেই আমাদের পূর্বসূরিদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা আমাদের নাড়া দিত না। তবে এখন আমরা এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই নয়, আমাদের বাঙালি জাতির পুরো ইতিহাস অন্তরে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। যদি আমরা নিজেদের দায়িত্বটুকুই ঠিকভাবে পালন করি, তবেই দেশকে ভালোবাসা হবে। এই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে স্বপ্নের সোনার বাংলা। মহান বিজয় দিবসের আনন্দ স্বার্থক হবে। মির্জা গালিব বেগ ছাফি সান্তাহার সরকারি কলেজ, বগুড়া। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ও ভালোবাসার দিবসটি হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছি। প্রতিবছর এই দিনটি ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয়। আমরা নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিজয় দেখিনি; কিন্তু আমরা শুনেছি জেনেছি সেই বিজয়ের আত্মকথা। আমাদের সবাইকে বিজয় দিবসের অর্জনকে ধারণ করে নতুনদের কাছে বিজয় দিবসের কথা তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নির্যাতন-নিষ্পেষিত হওয়ার কথা জানাতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, তা জানলে শিউরে উঠবে তরুণপ্রাণ। দেশের প্রতি জাগবে তাদের ভালোবাসা। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি একটা দেশ, একটা মানচিত্র, একটা পতাকা। নিজের একটা পরিচয়। কিন্তু আমরা কি আমাদের সেই দেশ, মানচিত্রের কিংবা পতাকার সঠিক সম্মান দিয়েছি বা দিচ্ছি? প্রতিনিয়ত উঠতে- বসতে আমরা আমাদের পতাকার অপমান করছি নিজেদের অজান্তেই। এখনো অনেককে দেখতে পাই শহিদ মিনারে জুতা পায়ে সেলফি তুলতে। সবাই যে করছে, তা নয়। তবে বেশির ভাগ মানুষই করছে। এর কারণ আমাদের অবহেলা, আমাদের জ্ঞানের অভাব। কিন্তু আর কত, এসব তো বন্ধ হওয়া দরকার। যে জাতি তার পতাকাকে সম্মান দিতে জানে না, সে জাতির উন্নতি অসম্ভব। দেশপ্রেমের প্রথম ধাপ হিসেবে আসুন নিজের পতাকাটাকে ভালোবাসি এবং এর মাঝেই দেশটাকেও আপন করে নিই। জাতি হিসেবে আমরা যে স্বাধীন তা যেন না ভুলি। মুনিয়া আজম মায়শা হাজী কাশেম আলী মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। আর সেই স্বাধীনতা যদি হয় ত্রিশ লাখ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত কোনো সম্পদ, তাহলে তো বলতেই হয় এই স্বাধীনতা কোনো সাধারণ স্বাধিকার নয়। বলছিলাম বাঙালি জাতীয় সত্ত্বার অন্যতম অংশ ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি যেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল তা পুরো বিশ্বকে যেমন হতবাক করে দিয়েছিল ঠিক তেমনি অত্যাচারী নরপশুদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, অন্যায়ভাবে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে খুব বেশিদিন শৃঙ্খলিত করে রাখা যায় না। এ জন্যই প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির এক বিশেষ উপলক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রতিবছর বিজয়ের মাস এলেই কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ভাষণের মাঝে। নিজেকে মিলিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে গগনবিদারী ধর্ষিত মায়ের আহাজারিতে। ইচ্ছা করে অধিকার আদায়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া সেই গরিব কৃষকের রাইফেলের ট্রিগারের সঙ্গে নিজের আঙুলটাকে একবার স্পর্শ করাতে। কিন্তুু পরেক্ষণেই মনে হয়, আমি তো একাত্তরের সেই মহানায়কদের কাছে এক মস্তবড় কাপুরুষ। সত্যিই একটি জাতি গঠনে একাত্তরের মানুষগুলোর অবদান ছিল তুলনাহীন। মহান বিজয় দিবসে আমার একটাই প্রত্যাশা, বাংলাদেশের সব মানুষের মাঝে এই আত্মোপলব্ধি হোক, যেন আমরা সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সেই আকাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারি। আব্দুলস্নাহ আল মুবাশ্বির হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত আমাদের এই বাংলাদেশ। রক্ত দিয়ে লেখা এই নামটি অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরিয়েছিল তরুণরা। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও তারাই আমাদের বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের তারুণ্যের উৎস। আজকের তরুণ হিসেবে আমি স্বাধীনতার জন্য আমার পূর্বপুরুষের লড়াই দেখিনি; কিন্তু অনুভবে বাঁধতে পেরেছি তাদের। আর তাইতো লাল সবুজের পতাকায় ফসলের মাঠে কৃষকের হাসিতে অনুভব করি বিজয় উলস্নাস। বিজয় আজও আমার কাছে তরুণই রয়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জন হলেও সর্বস্তরের মানুষের মুক্তি আজও অর্জিত হয়নি। আজকের তরুণরা যদি সেই পিছিয়ে পড়া সমাজের জন্য লড়াই করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতাহত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে, দেশ থেকে বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের মতো ব্যাধির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে একটি মেয়েকে নবজীবন দান করতে পারে, অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিতে এবং সর্বোপরি নিজের রাজনৈতিক চেতনার সুষ্ঠু বিকাশ ঘটাতে পারে, তাহলেই আসবে আমাদের বিজয়ের সাফল্য। তখনই মানুষ উপভোগ করবে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ। আমাদের বিজয় সেদিনই সফল হবে, যেদিন বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের অবদানে বাংলার ১৬ কোটি মানুষের মুখ থাকবে হাস্যোজ্বল, থাকবে না দুর্নীতি, থাকবে না কোনো অনাহারী, থাকবে না অশিক্ষা। পৃথিবীর মানচিত্রে লাল সবুজের বাংলাদেশ হবে নবজাগরণে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ। ফাতেমা আক্তার মনিকা গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশিরা বিশ্বের বুকে এক অপরাজেয় জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ বিজয় এখনো যে কোনো ক্ষেত্রে আমাদের জয় ছিনিয়ে আনতে সাহস জোগায়। ইতিহাসের এক হিংস্র ও নিকৃষ্ট পাকবাহিনীর কাছ থেকে যদি আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে আজ কেন আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ দলাদলি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পাশবিকতাকে পরাভূত করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি না? প্রতিটা বাংলাদেশির মতো আমিও স্বপ্ন দেখি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের। যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান সে স্বপ্নটা পূরণ করতে পারব এমনটাই আশা। বাকস্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এ দেশে যেন আকাশ-কুসুম কল্পনার মতো। এই আকাশ-কুসুম কল্পনা একদিন বাস্তবায়িত হবে এ দেশে। সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতার কালো আলখালস্না আমাদের দেশটাকে আরও পেছনে নিয়ে যেতে চাইছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় সবাই মিলে প্রতিরোধ না করলে পিছিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না আমাদের। আল আমিন ইসলাম সোহান বীরউত্তম শহিদ সামাদ কলেজ, রংপুর।