মূল ফটকে দেশের ইতিহাস

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের বাইরের অংশে প্রথমেই আপনার নজর কাড়বে পোড়ামাটি দ্বারা অঙ্কিত কিছু সংগ্রামী মানুষের ছবি এবং খোদাই করা কয়েকটি লেখা- 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি', 'দাম দিয়ে কিনেছি, বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়', 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' ইত্যাদি। পোড়ামাটিতে অঙ্কিত মানুষের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়বে কিছু সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধার ছবি। সঙ্গে রয়েছে একাত্তরের রণাঙ্গনের দিনগুলো পেরিয়ে বাঙালি জাতির বিজয়ের লগ্নে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে অর্জিত ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে অর্থবহ করে তুলতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকশিত করার লক্ষ্যেই মূল ফটকে এ ধরনের চিত্রাঙ্কন।

প্রকাশ | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
অনিক আহমেদ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগ্রাম শেষে বিজয় অর্জন, ভাষা আন্দোলন এবং দেশের প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গকারী কিছু সংগ্রামী নারীকে যদি একই ফ্রেমে রাখা হয়, তাহলে সেটাকে আপনি কি নামে অভিহিত করবেন? সাধারণ দৃষ্টিতে আমজনতা বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেও এটি কিন্তু অবাস্তব নয়। যদি বলি, উপরোক্ত বিষয়গুলোর বাস্তব চিত্র গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক, সম্ভবত অতু্যক্তি হবে না। এতক্ষণে সাধারণ আমজনতা তো দূরের কথা, শিক্ষিত সমাজের অনেকের চোখও হয়তো কপালে উঠে গেছে। অনেকে হয়তো ভেবেছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধের কথা। আপনাদের কৌতূহলী মনের চাহিদা মিটানোর জন্য আসুন বিষয়টা খোলাসা করি। রাজধানী ঢাকার অদূরে অবস্থিত সাভার উপজেলার নলামে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গণ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলিত ধারার সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে নিজেকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যসমূহের দেখা মিলবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকেই। দূর থেকে মূল ফটকের দিকে তাকালে হয়তো তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হবে না, তবে কাছ থেকে ফটকের উপরের অংশে খেয়াল করলে যা দেখবেন তাতে আপনার মন সহজেই ষাট-সত্তর বছর পেছনে ফিরে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের বাইরের অংশে প্রথমেই আপনার নজর কাড়বে পোড়ামাটির দ্বারা অঙ্কিত কিছু সংগ্রামী মানুষের ছবি এবং খোদাই করা কয়েকটি লেখার দিকে- 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি', 'দাম দিয়ে কিনেছি, বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়', 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' ইত্যাদি। পোড়ামাটিতে অঙ্কিত মানুষের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়বে কিছু সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধার ছবি। সঙ্গে রয়েছে একাত্তরের রণাঙ্গনের দিনগুলো পেরিয়ে বাঙালি জাতির বিজয়ের লগ্নে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে অর্জিত ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে অর্থবহ করে তুলতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকশিত করার লক্ষ্যেই মূল ফটকে এ ধরনের চিত্রাঙ্কন। মূল ফটকের বাইরের অংশে আরো রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য যে আন্দোলন তথা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কিছু সংগ্রামী মানুষের ছবি। মায়ের ভাষাতে কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য যে মানুষ জীবন দিতে পারে বাঙালি জাতিই প্রথম সেটা প্রমাণ করেছিল। সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতদের মতো যুবকদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া প্রাণের ভাষা বাংলা'র ইতিহাস যেন জাতি ভুলে না যায় সেই উদ্দেশ্যেই ফটকে এ ধরনের চিত্রাঙ্কন। বাংলা ভাষাকে বুকে ধারণ করার জন্য গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী কার্যক্রম। সেগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে (এড়হড় ইরংযধিনরফুধষধু) লেখা। শুধু বাহ্যিকভাবে ভাষা আন্দোলনের চেতনা বুকে ধারণ নয় বরং শিক্ষার্থীদের মনে বাংলা ভাষার ইতিহাস, জাতীয় সঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরস্থায়ী করতে প্রথম তিনটি সেমিস্টারে বাংলাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি পড়ানো হয় এবং সেসব কোর্সে পাস করে পরবর্তী সেমিস্টারে উন্নীত হতে হয়। মূল ফটকের কিছু অংশ দখল করে রয়েছে জাতীয় সঙ্গীতের একটি লাইন যা একজন শিক্ষার্থীর দেশপ্রেমকে জাগ্রত করবে। ফটকের একপার্শ্বে ছোট করে অঙ্কিত শান্তির প্রতীক কবুতরের চিত্র হয়তো ইঙ্গিত করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বদা শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজমান রাখতে সব শিক্ষার্থীকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে। মূল ফটকের বাইরের এসব চেতনা বুকে ধারণ করে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফটকের ভেতরের অংশে সুন্দর কারুকার্যে সাজানো এগারজন সংগ্রামী নারীর ছবি। প্রতিটি নারীই যেন একেকটি জীবন, একেকটি সংগ্রামের নাম। প্রত্যেকটি নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অসত্যের প্রতি ঘৃণা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিত্র। দেশের জন্য এসব মহীয়সী নারীর অবদান কখনোই ভোলার নয়। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দেয়ার মাধ্যমে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করে গেছেন তারা। কেউ শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন, কেউ লেখনীর মাধ্যমে, কেউবা শত্রম্নর ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। একটা জায়গায় এসে সবাই একবিন্দুতে মিলিত হয়েছেন, সেটা হলো প্রত্যেকের মনেই ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য এক অভূতপূর্ব ভালোবাসা- যার প্রমাণ তারা কাজের মাধ্যমে দিয়ে গেছেন। সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের মাঝেই প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে এভাবে তৈরি করা হয়েছে কি না, সেটাও ভাবার বিষয়, সম্ভবত পাওয়া যাবে না। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে এখানে আগত শিক্ষার্থীরা যেন তাদের নির্দিষ্ট বিষয়সমূহের ওপর জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি মুক্তচিন্তা, ভাষা আন্দোলন, এগারজন নারীর সংগ্রামী জীবনগাথা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির যে কোনো ক্রান্তিকালে প্রয়োজন হলে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করবে এমনটাই প্রত্যাশা সর্বসাধারণের। তাহলেই স্বার্থক হবে গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এবং জাতি পাবে কিছু তেজোদীপ্ত সূর্যসন্তান।