সাইফুল ইসলাম
১৯৯৪ সালের ৮ ডিসেম্বর মাত্র দু'জন শিক্ষক আর ২৩ জন শিক্ষার্থী, একটি শ্রেণিকক্ষ নিয়ে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের অধীনে শুরু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পথচলা। শুরুটা খুব বেশি সুখকর ছিল না বিভাগটির। অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা আর জীর্ণ কলা অনুষদের নিচতলায় স্যাঁতসেঁতে শ্রেণিকক্ষে ভাগাভাগি করে ক্লাস এবং পরীক্ষা দিতে হতো শিক্ষার্থীদের। ছিল না সেমিনার কক্ষ এবং কম্পিউটার ল্যাবের কোনো ব্যবস্থাও। শুরুতে বিভাগটির নাম দেওয়া হয়েছিল সাংবাদিকতা। পরে ২০০৩ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। পাঠ্যসূচিতেও আনা হয় পরিবর্তন। ২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ থেকে বিভাগটি নিয়ে আসা হয় সমাজবিজ্ঞান অনুষের অধীনে। বর্তমানে এই বিভাগের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫০ জনেরও অধিক এবং শিক্ষক রয়েছেন ২১ জন। শুরু থেকে নানা উত্থান আর বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে হাঁটিহাঁটি পা পা করে ২০১৯ সালে এসে বিভাগটি পূর্ণ করছে ২৫ বছর।
আর এই ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভাগটির অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে গত ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর জাঁকজমকপূর্ণ এক রজতজয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করা হয়। দুদিনব্যাপী উৎসবের প্রথমদিনের অনুষ্ঠান ছিল পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে লীলাভূমিখ্যাত চিরসবুজের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণ, আর দ্বিতীয় দিনের আয়োজন করা হয়েছিল শহরের স্বনামধন্য পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন বস্নুতে। এই উৎসবে প্রায় ১ হাজার নবীণ-প্রবীণদের মিলনামেলা ঘটেছিল। বর্তমানরা যেমন সাবেকদের পেয়ে আনন্দ-উলস্নাসে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছিল তেমনি সাবেকরাও তাদের বহুদিন আগের বন্ধুদের পেয়ে ক্ষণিকের জন্য মেতে উঠেছিল প্রাণের উচ্ছ্বাসে।
যাত্রা শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভাগটি থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় ২০টি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। সবুজ ক্যাম্পাস ছেড়েছেন তারা। কাজের সূত্রে কেউ রয়ে গেছেন চট্টগ্রামে, কেউ কেউ গেছেন ঢাকাসহ দূরদূরান্তে। দেশের বাইরেও গেছেন অনেকেই। এই বিভাগের মায়ায় স্মৃতির টানে অনেকে চলে এসেছেন সূদর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড এবং তুরস্ক থেকে। তাদের কেউ এখন গণমাধ্যমের তুখোড় সাংবাদিক, কেউ প্রশাসনে, কেউ বা করপোরেট অফিসের বড় কর্মকর্তা, আবার কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিবিদ।
এমনই একজন শিক্ষার্থী বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্রী ফারাহ্? নাজ মুসারাত। যিনি এই অনুষ্ঠানের টানে ছুটে এসেছন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া থেকে। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'যখন জানতে পারি যে, আমাদের বিভাগের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান হবে, তখন থেকেই আসলে আমি খুব এক্সাইটেড। মূলত এই রজতজয়ন্তীতে অংশগ্রহণ করার জন্যই বাংলাদেশে আসা। বিভাগের শিক্ষক-সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হবে, ভাবতেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল। এখন দেখা হওয়ার পর যে অনুভূতি, সেটা আমি বলে বোঝাতে পারব না।'
বর্তমানে চলমান সর্বশেষ ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান রাব্বি অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, 'ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই এত বড় একটা অনুষ্ঠান পাওয়া আসলে ভাগ্যের ব্যাপার। রজতজয়ন্তীর দুদিন ছিল আমার জীবনে অন্যতম একটি সুন্দর দিক। এতগুলো সাংবাদিক বড় ভাইদের কখনো দেখা করা বা কথা বলা সম্ভব হতো না এই অনুষ্ঠান না হলে। এত নিখুঁত সফল একটি অনুষ্ঠান উপহার দেওয়ার জন্য আমি বিভাগের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।'
অনুষ্ঠানটিতে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন, চবি উপচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। এ ছাড়াও বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, পিএইচপি গ্রম্নপের চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমান, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক, প্যাসিফিক জিন্সের পরিচালক তানবীর আহমেদ, পেড্রোলো গ্রম্নপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান খান এবং চট্টগ্রামের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং সাউদার্ন মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার আতিকুল ইসলাম চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা একটি মহৎ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। সাংবাদিকতা একটি সম্মানিত পেশা, এটিকে রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ বলা হয়। সংসদ, আইন ও আদালতের পরেই সাংবাদিকতাকে বিবেচনা করা হয়। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সুশীল সমাজ ও একটি দেশের নাগরিকের মতামত প্রকাশিত হয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে জানা, শিখা ও সংশোধন হওয়া যায়। তাই আপনাদের সতর্কতার এবং সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতি আপনাদের কাছ থেকে উপকৃত হতে পারবে।
এ ছাড়াও অতিথিদের মধ্য থেকে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং সাউদার্ন মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার আতিকুল ইসলাম চৌধুরী রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, 'চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নে সাংবাদিকদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যদি সাংবাদিক এবং চিকিৎসকদের মধ্যে যৌথ মতবিনিময়ের যত বেশি সুযোগ থাকবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নানান সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়টি মিডিয়ায় ততবেশি উঠে আসবে। দেশের চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে সাংবাদিকরাই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।'
রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে বিভাগের শিক্ষা গবেষণা, ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বর্তমান শিক্ষার্থীদের সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে ২০১৭ সালের ১০ মার্চ বিভাগটির সভাপতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু শিক্ষক ও একদল সৎ, দক্ষ এবং মেধাবী সাবেক শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় আর প্রচেষ্টায় যাত্রা শুরু করে এই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনটি। যাত্রা শুরু করার দুই বছরের মাথায় তারা বিভাগকে দিয়েছে একট সফল এবং সুশৃঙ্খল রজতজয়ন্তী। যা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদসহ সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছ এবং সবার কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে সফল অনুষ্ঠানের। অনেকে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্য এবং বিভাগের শিক্ষকদের।
এ বিষয়ে বিভাগের সভাপতি ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'নিঃসন্দেহে এটা যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কোনো অনুষ্ঠান এবং বিভাগের জন্য তা বিরাট একটি অর্জন। আর এই অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য আমি আন্তিরকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্য এবং আমার বিভাগের সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই এই রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানটি সফলতা পেয়েছে। আমি নিজেও এই বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী। সেই হিসেবে আনন্দটা অন্যদের তুলনায় আমার একটু বেশি।'
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী শিমুল নজরুল বলেন, 'আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাবেক এবং বর্তমানদের একটা মিলনমেলার আয়োজন করা। সবার প্রচেষ্টায় আমরা সেটা করতে পেরে নিজেরাও খুব আনন্দ বোধ করছি। তিনি আরও জানান, প্রতি বছর এবারের মতো অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হবে এবং প্রতি পাঁচ বছর পর পর পুনর্মিলনীর আয়োজন করবেন।