অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে জন্মদিন

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানকার ভাস্কর্য শিল্প বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির শ্রেষ্ঠ বীরদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে সংশপ্তক, অমর একুশ, শহিদ মিনার। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাস্কর্যগুলো অনুপ্রেরণা জাগায় দেশের কল্যাণে কাজ করার জন্য। ভাস্কর্যগুলো আমাদের যুদ্ধ, ত্যাগ এবং রক্তপাতের অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।

প্রকাশ | ১৩ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ইমরান হোসাইন হিমু
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। তবে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এর আগেই ৪ জানুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান উপাচার্যের নাম ড. ফারজানা ইসলাম। উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ২০১৪ সালের ২ মার্চ থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিমে অবস্থিত। এটি ৬৯৭.৫৬ একর (২.৮ বর্গকিলোমিটার) জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। ক্যাম্পাসটির উত্তরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, উত্তর-পূর্বে সাভার সেনানিবাস, দক্ষিণে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং পূর্বে একটি বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদন খামার (ডেইরি ফার্ম) দ্বারা পরিবেষ্টিত। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকারের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম 'জাহাঙ্গীরনগর' থেকে এই নামকরণ করা হয়। প্রথম ব্যাচে ১৫০ জন ছাত্র নিয়ে ৪টি বিভাগ চালু হয়; বিভাগগুলো হচ্ছে- ভূগোল, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ও গণিত। পরবর্তী সময়ে যুগের চাহিদা অনুযায়ী যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বিভাগ। ফলে বর্তমানে মোট বিভাগ দাঁড়িয়েছে ৩৫টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন নিযুক্ত হন ১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনের প্রায় চার মাস পূর্বেই। তারপর বিভিন্ন সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, লোকসাহিত্যবিদ মাজহারুল ইসলাম, লেখক জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, আ ফ ম কামালউদ্দিন, আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ আব্দুল বায়েস, আলাউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমানসহ ১৮ জন সম্মানিত ব্যক্তি। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দেশবিখ্যাত লেখক হায়াত মাহমুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, কবি মোহাম্মাদ রফিক, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুল ইসলাম, আবু রুশদ মতিনউদ্দিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, ইতিহাসবিদ বজলুর রহমান খান, সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তি। \হবিশ্ববিদ্যালয় শুরু পর পরই এ দেশে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা মায়ের বুকে যখন শকুনরা হামলে পড়ে তখন এখানকার ছাত্র- শিক্ষকরা ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে রক্ষার সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশকে শিক্ষা সংস্কৃতিতে নতুন করে সাজাতে পুরোদমে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ক্রমে বিভাগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলাদেশের প্রথম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরুতে দুইটি অনুষদ নিয়ে যাত্রা করলেও পরের বছর কলা ও মানবিকী অনুষদ খোলা হয়। আইন অনুষদের অধীন আইন ও বিচার বিভাগ ২০১১ সালে পদচারণা শুরু করে। বিভাগের প্রথম সভাপতি ড. শাহাবুদ্দিন। ২০১৫ সালে আইন ও বিচার বিভাগের ১ম ব্যাচ এলএলবি সম্পন্ন করে। বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অনুষদ সংখ্যা ৬টি। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ছাত্র সংখ্যায় এটি ক্ষুদ্রতম। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাইকে চিনে। একে অপরের মাঝে গড়ে উঠেছে প্রীতির বন্ধন। ফলে দেশের যে প্রান্তেই জাবির শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়লে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় সবাই। ছাত্র সংখ্যায় কম হলেও জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এরশাদ সরকারের আমলে শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে দাবি আদায় করে। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মানিক ও তার সঙ্গীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিতাড়িত হয়। কিছুদিন পর তারা পুনরায় ফিরে এলে ১৯৯৯ সালের ২ আগস্ট শিক্ষার্থীদের এক অভু্যত্থানে ওই অভিযুক্তরা পুনরায় বিতাড়িত হয়। এই আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন বলে পরিচিত। ছাত্র কেন, শিক্ষকদের কাছেও মাথা নত করেননি এখানকার শিক্ষার্থীরা। ২০০৫, ২০০৬, ২০০৮ ও ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বেতন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি বন্ধ, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, পানি সরবরাহ, আর্থিক স্বচ্ছতাসহ বিভিন্ন দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন করে। বিদ্যায়তনিক পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কর্মকান্ড উলেস্নখযোগ্য। সাহিত্য চর্চায় বাংলা বিভাগ, মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ছাড়াও উয়ারী ও বটেশ্বরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকার্য, দেশীয় নাট্যচর্চায় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অবদান, নৃবিজ্ঞান চর্চায় এখানকার নৃবিজ্ঞান বিভাগ, বিজ্ঞান গবেষণায় 'ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগার অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। এ ছাড়াও পহেলা বৈশাখে উদযাপন, বসন্তবরণ, শীতকালে হিমু উৎসব, পাখি সচেতনতায় পাখি মেলা, প্রজাপতি রক্ষায় প্রজাপতি মেলা, বিজ্ঞানপ্রেমীদের বিজ্ঞান মেলাসহ নানা আয়োজন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শ্যামল পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য জলাশয় ও বনাঞ্চল পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে উঠেছে। লেকের পানিতে লাল শাপলা আর অতিথি পাখিদের বিচরণের ফলে পাখি প্রেমীদের এক পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া শান্তিনিকেতন, রাঙ্গামাটি, সুইজারল্যান্ড,আব্বাস মহাসাগর, টারজান পয়েন্ট দেখতে পাবেন এই ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানকার ভাস্কর্য শিল্প বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির শ্রেষ্ঠ বীরদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে সংশপ্তক, অমর একুশ, শহিদ মিনার। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাস্কর্যগুলো অনুপ্রেরণা জাগায় দেশের কল্যাণে কাজ করার জন্য। ভাস্কর্যগুলো আমাদের যুদ্ধ, ত্যাগ এবং রক্তপাতের অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বাভাবিকভাবে মৃতু্যবরণকারী শিক্ষার্থীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে মুরাদ চত্বর, মুন্নী স্মরণি, জুবায়ের স্মরণি, স্বপ্না স্মরণি, কবির স্মরণি। বিশ্ববিদ্যালয়টি এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সব সেক্টরে যোগ্য নেতৃত্ব জোগান দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের কারণে সব শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। যারা একবার এই ক্যম্পাসে আসে, এর মায়া কখনো ছাড়তে পারে না কেউই। তাইতো এখানকার শিক্ষার্থীদের কাছে দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছে এই ক্যাম্পাস।