চ ট্ট গ্রা ম বি শ্ব বি দ্যা ল য়

বংশগতি নয়, পরিবেশই অধিক ভূমিকা রাখে শিশুর জীবনধারায়

প্রকাশ | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সাইফুল ইসলাম
বংশগতির ধারক (ডিএনএ) মানুষের দেহের বিকাশ ও পরিণত বয়সের নানা বিষয়কে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানের এমন প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে সম্প্রতি চ্যালেঞ্জ করেছেন একদল গবেষক। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক জনপ্রিয় জার্নাল 'দি ন্যাচার'-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে তারা দেখিয়েছেন, জিনগত বৈশিষ্ট্যের চেয়ে শিশুর শৈশবকালীন পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থা অনেক বেশি ভূমিকা রাখে তার জীবনধারায়। ইতোমধ্যে এই গবেষণাটি আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া জাগিয়েছে। নানান গবেষণায় অসংখ্যবার উদ্ধৃতও হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এই ফলাফলকে 'এক নতুন সংযোজন ' বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই যৌথ গবেষণা কর্মে চারজন নৃবিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ। অপর তিনজন হলেন- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্যাসন মাগিড, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনিয়ান বেনটলি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট চেটারটন। গবেষণা কর্মটি 'ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (ইএসআরসি)', 'দ্যা রয়্যাল সোসাইট অ্যান্ড প্রোস্টেট ক্যান্সার ইউকে' এবং গবেষকদের নিজস্ব অর্থায়নে সম্পাদিত হয়। গবেষণাটির কার্যক্রম, চ্যালেঞ্জ, সাফল্য ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বলেন, 'গবেষণায় আমরা ৩৫৯ জন বাংলাদেশি, ইউরোপীয় বংশদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক এবং বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ব্রিটিশ বাঙালিদের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করি। গবেষণাটিতে স্বাস্থ্যকর ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠা মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় তথ্যদাতাদের ওজন, উচ্চতা, স্বাস্থ্যগত ও বয়ঃপ্রাপ্তির সময়কাল সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্যদাতাদের টেস্টোস্টেরনের প্রবাহ পরিমাপ করা হয় সংগৃহীত মুখে নিঃসৃত লালায় স্যালিভারি টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয় ভিন্ন পরিবেশ বেড়ে উঠা তথ্য দাতাদের শারীরিক গড়ন, ওজন, উচ্চতা, বয়ঃপ্রাপ্তি, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং দেহে স্যালিভারি টেস্টোস্টেরনের প্রবাহ মাত্রার উলেস্নখযোগ্য তারতম্য রয়েছে। আমাদের গবেষণায় উঠে আসে, শৈশবের ভালো পরিবেশের কারণে নানা ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি গঠনগতভাবেও আগের প্রজন্মকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। যেসব পুরুষ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সচ্ছল পরিবার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগমুক্ত শৈশব কাটিয়ে বেড়ে উঠে তাদের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি হয়। তারা দ্রম্নত বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায় এবং দ্রম্নত দীর্ঘ দৈহিক গড়নের অধিকারী হয়। তবে পরিণত বয়সে তারা প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। অন্যদিকে যেসব পুরুষ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হতে শৈশব পার করে পরিণত বয়সে তাদের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ কম হয়। শরীরে কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের হার আবার মানব শরীরের দীর্ঘস্থায়ী (ক্রোনিক) অসুস্থতার জন্য দায়ী। আমাদের দেহে দৈনন্দিন শরীরবৃত্তীয় কর্মকান্ডে একগুচ্ছ হরমোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার মধ্যে টেস্টোস্টেরন অন্যতম। টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষ শরীরের শারীরিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পুরুষের বয়ঃপ্রাপ্তি, শারীরিক গঠন, উচ্চতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি টেস্টোস্টেরনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এ ধরনের ঝুঁকি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তির শৈশবে বেড়ে ওঠার পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।' অপরদিকে কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদন শারীরিক দুর্বলতা তৈরি করে এবং যৌন কার্যকারিতা হ্রাস করে। আমাদের গবেষণা অনুসারে পুরুষদের প্রজনন সক্ষমতা বয়ঃসন্ধিকাল থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে থাকে। ফলে শৈশবের শেষ পর্যায় হতে প্রারম্ভকালে তুলনামূলকভাবে অধিক নমনীয় থাকে। এ ছাড়া গবেষণার তথ্য মতে, প্রাপ্ত বয়সে পুরুষের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা তার পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয় না।  ড. ফরিদ আরও বলেন, 'একজন পুরুষের হরমোন নিঃসরণের পরিপূর্ণ মাত্রা তার বংশ-পরম্পরা কিংবা পরিণত বয়সে তিনি যেখানে বসবাস করে এর ওপর নির্ভর করার কথা থাকে। কিন্তু বাস্তবে তা নির্ভর করে তার শৈশবকালীন পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। এটি এ গবেষণার অন্যতম বড় একটি প্রাপ্তি। গবেষণার ফলাফল অনুসরণে উন্নত পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। এ ছাড়াও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য খাতের বিপুল পরিমাণ ব্যয়ও কমিয়ে আনা যাবে। আমি আশাবাদী কেবল বাংলাদেশেই নয় অন্যান্য দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য খাতে এই গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।