বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন ভ্রমণে

আমাদের দেখেই হরিণদের দৌড়াদৌড়ি শুরু। বাঘ না দেখলেও বাঘের গর্জন শুনি। বাঘ দেখা নাকি সৌভাগ্যের বিষয়। পরে আবার নৌকায় করে যাই কটকা হেড অফিসে। সেখানে ছিল ভাঙা দুটো বড় নৌকা। সবাই মিলে গ্রম্নপ ছবি তুলি সেখানে। ভিতরে ছিল হরিণ। আমরা সবাই হরিণদের নিজ হাতে কেওড়াগাছের পাতা খাওয়াই। পরে লঞ্চে ফিরে রওনা হই হিরণপয়েন্টের উদ্দেশে। এবার দুপুরের খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয় ১৩ নদীর মোহনার ওপর। ৫টার দিকে পৌঁছাই হিরণপয়েন্ট। হাঁটতে হাঁটতে হরিণ, বানর, গুঁইসাপ ও কুমির দেখি। সেখানে ছিল সুন্দরবনকে বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদানের ফলক। বিস্তারিত লিখেছেন- তানিউল করিম জীম

প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল সুন্দরবন। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের আয়তন ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে ইউনেস্কো। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবনের ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটারজুড়ে নদী-নালা ও বিল মিলে রয়েছে জলাকীর্ণ অঞ্চল। রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিচিত্র ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। আরও রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রাজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রাণী। সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এই বনের নাম রাখা হয় সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভেতরে যেতে হলে নৌপথই একমাত্র উপায়। তাই তো বিশ্বঐতিহ্যের সাক্ষী সুন্দরবনের সম্পদ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির আমরা ১২ জন সদস্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হই। ভ্রমণ শুরুর জন্য আমরা সবাই সন্ধ্যায় সমিতির সামনে এসে উপস্থিত হই। সেখান থেকে অটোতে করে আসি ময়মনসিংহের জিরো পয়েন্টে। রাত সাড়ে ৮টায় বাস ছাড়ে খুলনার উদ্দেশ্যে। ১০ ঘণ্টা জার্নি করে পৌঁছাই খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে। সেখান থেকে আবার অটো করে পৌঁছাই জেলখানা ঘাটে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সুন্দরবন টু্যরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের শাকিল ভাই। পরে নৌকায় করে আমরা আমাদের ভাড়া করা লঞ্চ এম এল সোহান মুন্নায় পৌঁছাই। এদিকে লঞ্চে উঠে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি রুম দখল করতে। লঞ্চের কক্ষগুলো ছিল সুন্দরভাবে সাজানো, পরিষ্কার ও গোছানো। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা করি। পরে ভৈরব নদীপথেই শুরু হয় আমাদের সুন্দরবন যাত্রা। শুরু হয় আমাদের নৌপথের ভ্রমণ। এই লঞ্চে তিনদিন ঘুরে দেখব সুন্দরবনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। লঞ্চে থেকেই দেখতে পাই রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র। রনিভাই শুশুক দেখেই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। চলতে চলতে আমরা পৌঁছাই মোংলা বন্দরে। সেখানে আছে সিমেন্ট কারখানা, গ্যাস কারখানা, খুলনা শিপ ইয়ার্ডসহ ছোট-বড় আরও কারখানা। বড় বড় জাহাজের দেখাও মেলে এখানে। কোনোগুলো যাত্রীবাহী, কোনোগুলো মালবাহী। আর আছে নৌবাহিনীর জাহাজ। লক্ষ্য করে দেখলাম জাহাজগুলোর উপরের অংশ সাদা রঙের হলেও নিচের রং ভিন্ন ভিন্ন। অন্যদিকে নৌবাহিনীর জাহাজটি পুরোটাই ছিল নেভি কালারের। চলতি পথে অনেক বড় বড় তেলবাহী জাহাজেরও দেখা মিলেছে। ঢাঙ্গমারী বনবিভাগ থেকে আমাদের নিরাপত্তার জন্য একজন ফরেস্ট গার্ডকে দেওয়া হয়। দুপুরে ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষ রোস্ট ও ইলিশ মাছের এক সুস্বাদু রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা করে। সারিসারি গোলপাতার গাছ, গেওয়া গাছ সাজানো। গেওয়া গাছগুলো দেখলাম সব একই আকারের। সবাই লঞ্চে বসেই সুন্দরবনের অপরিচিত গাছের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে বিকালে আমরা পৌঁছায় আমাদের প্রথম স্পট হাড়বাড়িয়া ইকো টু্যরিজম কেন্দ্রে। কাঠের তৈরি সুন্দর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত হই সুন্দরবনের সুন্দরী, পশরগাছের সঙ্গে। দেখি হরিণদের ছুটে চলা। আরও দেখি শ্বাসমূল, দেখি বড় বড় মৌচাক। সন্ধ্যার আগেই আবার উঠে পড়ি লঞ্চে। রাতে ঠান্ডা বাতাসের কারণে আর বাইরে আড্ডা দেওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে রুমেই শুরু হয় আড্ডা। কেউ গান-বাজনা, কেউ খোশগল্প, কেউ আবার লুডু খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ভোরে কটকায় নামাতে হবে। তাই সবাই একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। সারারাত লঞ্চ চলে সকাল ৬টায় পৌঁছায় কটকায়। নৌকায় করে সবাই ঘাটে নেমে রওনা হই জামতলা সি বিচ দেখার জন্য। জঙ্গলের মধ্যদিয়ে ৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছাই টাইগার পয়েন্টে। যেখানে হরিণরা গায়ে রোদ লাগানোর জন্য এলে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়। সুন্দরবনের মধ্যে সূর্যোদয়ের দৃশ্যতা ছিল দেখার মতো। বিশাল সবুজের মধ্যে একটা রক্তিম বলয়। এদিকে সামনে ছিল বালির রাস্তা। বালির মধ্যদিয়ে যেতে সবাইকে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। বালির রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছাই সি বিচে। সি বিচের বেশি সামনে যাওয়ার উপায় ছিল না চোরাবালির কারণে। কাঁকড়ারা বিচে সুন্দর নকশা করে রেখেছে দর্শনার্থীদের জন্য। বিচের মনোরম ও স্নিগ্ধ পরিবেশে সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অনেকে বাঘের পায়ের ছাপ দেখার জন্য চলে যাই। এবার আবার হেঁটে ঘরে ফেরার পালা। হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন গাছের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত সবাই। বৃদ্ধ ফরেস্ট গার্ডের একটু কষ্টই হচ্ছিল হাঁটতে। আসার সময় টাইগার পয়েন্টে অনেক হরিণ দেখলাম। বাঘ নাকি আশপাশেই আছে বলল গাইড শাকিলভাই। আমাদের দেখেই হরিণদের দৌড়াদৌড়ি শুরু। বাঘ না দেখলেও বাঘের গর্জন শুনি। বাঘ দেখা নাকি সৌভাগ্যের বিষয়। পরে আবার নৌকায় করে যাই কটকা হেড অফিসে। সেখানে ছিল ভাঙা দুটো বড় নৌকা। সবাই মিলে গ্রম্নপ ছবি তুলি সেখানে। ভিতরে ছিল হরিণ। আমরা সবাই হরিণদের নিজ হাতে কেওড়াগাছের পাতা খাওয়াই সেখানে। পরে লঞ্চে ফিরে রওনা হই হিরণপয়েন্টের উদ্দেশে। এবার দুপুরের খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য হয় ১৩ নদীর মোহনার ওপর। ৫টার দিকে পৌঁছাই হিরণপয়েন্ট। হাঁটতে হাঁটতে হরিণ, বানর, গুঁইসাপ ও কুমির দেখি। সেখানে ছিল সুন্দরবনকে বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদানের ফলক। যেটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পানিতে আগুন জ্বলার মতো একটা লাইন ছিল। মানে সেখানকার পানিতে মিথেনের উপস্থিতি আছে। আরও ছিল খাবার পানির পুকুর। ভাটা পড়বে বলে সেখানে বেশিক্ষণ থাকা হয়নি। আমরা নৌকা নিয়ে লঞ্চের দিকে ফিরে আসার সময় দেখি, যে একটি ছোট লঞ্চ ভাটার কারণে আটকা পড়েছে। তাদের এখন ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের জন্য। আমরা লঞ্চে ফিরে আবার রওনা দিলাম দুবলার চরের উদ্দেশে। সাড়ে ৬টায় সেখানে পৌঁছালাম। তখন সূর্যাস্তের সময় ছিল। সেই হলুদাভ সূর্যকে ক্যামেরার মাধ্যমে হাতের কাছে এনে ছবি তুলতে ব্যস্ত সবাই। অন্য এক গ্রম্নপের সবাই চরে একটা ফুটবল ম্যাচ শেষ করে। বিশাল শুঁটকি পলস্নী ঘুরে দেখি। তাদের ব্যস্ততা অনেক। চরে হাঁটতে হাঁটতে ভাটায় আটকে পড়া জেলিফিশ, শাপলা মাছ, সাপের দেখা মেলে। পানির মধ্যেও জীবন দেখলাম জেলিফিশে। আসার সময় কম টাকায় সবাই ব্যাগ ভরে শুঁটকি নিয়ে নিই। পরে আমাদের শেষ স্পট করমজল প্রজননকেন্দ্র দেখার জন্য লঞ্চে উঠি। সারারাত লঞ্চ চলে। সকাল ৭টায় আমরা করমজলে পৌঁছাই। এখানেই মানুষ বেশি আসে কারণ এটাই সুন্দরবনের সবচেয়ে কাছের জায়গা। বিভিন্ন স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখানে পিকনিকে আসে। এখানকার বানরদের স্বভাব একটু খারাপ। হাতের জিনিস ভোঁ করে নিয়ে চলে যায়। ছিল ইরাবতী ডলফিনের কঙ্কাল, কুমির, হরিণ। আর সুন্দরীগাছসহ নাম না জানা গাছের সংগ্রহশালা। দেখা শেষে রওনা দিই খুলনার উদ্দেশে। খুলনায় পৌঁছাই বিকাল ৪টায়। সেখান থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করি। এই তো সুন্দরবন টু্যর শেষ। টু্যর শেষ কিন্তু ৩ দিনের যা যা দেখেছি, যা অভিজ্ঞতা নিয়েছি তা শেষ হবে না কোনো দিন। স্মৃতির কোনো এক পাতায় থেকে যাবে আজীবন। বিশাল এই সুন্দরবন আমাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে। তাই এই বন রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই সুন্দরবনকে সংরক্ষণ করতে হবে।