শরতের ছুটিতে গ্রামে

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শামীম শিকদার
স্কুলের বাংলা স্যার বরাবরই খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে গুছিয়ে কথা বলে। তার উপস্থাপনায় একেবারে সাধারণ তুচ্ছ জিনিসটিও খুব বেশি আকষর্ণীয় মনে হয়। স্যারের উপস্থাপনার মধ্যে যেমন থাকে শিক্ষনীয় দিক ঠিক তেমনই থাকে রসিকতাও। তাই কেউ বিরক্ত বোধ না করে গভীর আগ্রহের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকে। এশাও তার বিপরীত নয়। ক্লাসের সবার থেকে তার আগ্রহটা একটু বেশি বলেই তার নিজের কাছে মনে হয়। বিশেষ করে কোনো প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করলে সব কিছু ভুলে সে আলোচনায় গভীর মনোযোগ দেয় এশা। কারণ সে প্রকৃতিকে খুব উপভোগ করতে ভালোবাসে। ছোট থেকে শহরে বেড়ে ওঠায় প্রকৃতির সঙ্গে মিশার মতো তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় কেমন যেন একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। ক্লাসে বাংলা স্যার আলোচনা শুনে বারবার প্রকৃতির মধ্যে মিশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা হয় অজানা কোনো দেশে। প্রতি ঋতুর শুরুতে সে ঋতু সম্পকের্ যাবতীয় আলোচনা করেন স্যার। আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে শরৎকাল নিয়ে। প্রকৃতিতে এখন শরৎকাল। ভাদ্র-আশ্বিন এ দুই মাস শরৎকাল। শরতে প্রকৃতি হেসে ওঠে। শরৎকালের প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত, স্নিগ্ধ, উদার। অনুপম সৌন্দযর্ নিয়ে ঋতুর রানী শরতের আগমন। শরতের আকাশে জমে থাকে স্বচ্ছ কাচের মতো সাদা টুকরো টুকরো মেঘ। হঠাৎ করেই অঝরে বৃষ্টি নামে আবার মুহূতের্ই বৃষ্টি থেকে রোদে চারদিক আলোয় ভরে তোলে। শরতে রকমারী ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। এ সময়ে নদীর কিনারে বালির চরে হেসে ওঠে কাশবন। শুধু কাশবনই নয়, শরতে ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে গোটা প্রকৃতি। এ প্রকৃতিতে শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, শিউলি জবা, কামিনী, মালতি, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম ফুল, বরই ফুল, দোলনচঁাপা, বেলি জারুল, কামিনী, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, শ্বেতকাঝন, রাধাচ‚ড়া, স্থলপদ্ম, বোগেনভেলিয়াসহ নানান রঙের ফুলে প্রকৃতিকে সাজায় নতুন এক রূপে। স্যারের আলোচনায় শরত ঋতুর বৈশিষ্ট্য শুনে এশা মুগ্ধ। স্যারের মুখে শুনে নয়, নিজে শরতের প্রকৃতি উপভোগ করার ইচ্ছায় তার মনে একটি নতুন ভাবনার সূচনা হয়েছে। সে বারবার ভাবছে, কীভাবে শরৎঋতুর অপরূপ সৌন্দযর্ উপভোগ করা যায়। কোথায় গেলে প্রকৃত শরৎকে উপভোগ করা যাবে, এমন ভাবনা থেকেই হঠাৎ মনে পড়ল দাদুর বাড়ির কথা। গ্রাম ছাড়া এ প্রকৃতি পরিপূণর্ভাবে উপভোগ করার মতো শহরে ভালো কোনো জায়গা পাবে না তা সে জানে। তাই তার ভাবনাকে কেন্দ্র করে বাবার কাছে বায়নার তালিকায় গ্রামে যাওয়ার বায়না যোগ হলো। বাবাও কোনো কিছু না ভেবে মেয়েকে হ্যঁা বলে দিয়েছে। অন্যদিকে মা তাদের দুজনের প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে বলছে, মেয়েটির স্কুল বন্ধ করে এখন গ্রামে যাওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। মায়ের কথা শুনেই এশার সে কি কান্না। এবার এশার বাবা আর চুপ নেই। এই যে, মেয়েকে কান্না না করালে তোমার আর ভালো লাগে না। এখন ভালো লাগছে তোমার? এশার মা বাধ্য হয়ে এক বাক্যে মেনে নিল আগামী সপ্তাহেই তারা গ্রামে যাবে। তবে দাদু বাড়িতে নয় মামা বাড়িতে। মায়ের কথা শুনে এশা কান্না থামিয়ে তার প্রয়োজনীয় কাজ করছে। দেখতে দেখতে সাত দিন অতিবাহিত হয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার দিন চলে এলো। পুরো সাত দিনজুড়েই ছিল এশার প্রস্তুতি গ্রহণ। ব্যাগ ভরে নানান জিনিস নিয়েছে সে। এত কিছু নেয়ার পরও তার মনে হচ্ছে কি যেন নেয়া হলো না। আনন্দের ছেঁায়া তার মন গড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাতাসের সঙ্গে সবুজপাতার অস্বচ্ছ ঘ্রাণ তার নাকে বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। চিরচেনা সবুজগাছগুলো যেন তাদের সঙ্গে দৌড়ে ছুটছে তার মামাবাড়িতে। গাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঝক ঝকা ঝক ছুটছে ট্রেনও। মাঠ পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে নদী অতিক্রম করে মামা বাড়িতে এলো তারা। গ্রামের ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এশার মনে শরতের প্রকৃতি নিয়ে স্যারের আলোচনার বিষয়গুলো মনে পড়তে শুরু করল। তার মন আর দেরি সইছে না। নদীর পাড়ে কাশবনে যাওয়ার জন্য সে শরৎকে খুঁজছে। অনেক খেঁাজাখঁুজির পর তার মামাতো ভাই শরৎকে খুঁজে পেল সে। সাদা সাদা কাশফুলগুলো স্নিগ্ধ বাতাসে উড়ছে। নদীর দুই ধারে ছেয়ে আছে সাদা স্বচ্ছ মেঘের মতো কাশফুলে। নদীর তীরে বঁাধা রয়েছে ছোট একটি ডিঙি নৌকা। তারা দুজন ডিঙি নৌকায় বসে নদীর পানি ছুঁয়ে মনের প্রশান্তি খুঁজে পেল। নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি, গ্রামের এক প্রান্তে নদীর ধারে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া শুভ্র কাশফুলের স্নিগ্ধতা মনকে আর বেশি প্রকৃতপ্রেমী করে তুলেছে। এ ছাড়া মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানির মুগ্ধতায় আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতি ভরে তুলেছে নতুন সাজে। নদীর পাশেই কিছু লোক জমি পরিষ্কার করছে। এশা কৌত‚হলবসত শরৎকে জিজ্ঞেস করল, জমি পরিষ্কার করে লোকগুলো কি করবে? শরৎ গ্রামের ছেলে বলেই সে গড়গড় করে বলছে, জমি পরিষ্কার করে তা চাষ দিয়ে আমন ধান লাগাবে। হেমন্তে সে আমন ধান ঘরে তোলা হবে। এশা ঠিক বুঝতে পেরেছে কারণ সে বইয়ে বহুবার এই আমন ধানের কথা পড়েছে। রোদের মধ্যেই হঠাৎ করে আকাশ থেকে অঝরে বৃষ্টি ঝরছে। কোনো কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তারা দুজনে বাড়ির দিকে দ্রæত ছুটে এলো। সন্ধ্যার পর সবাই বাড়ির উঠানে বসে নানা ধরনের গল্প করে। আজকে সবার গল্পের মধ্যে এশাও যোগ দিয়েছে। সে লক্ষ্য করল উঠানে বাতি ছাড়াই সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল আকাশ থেকে চঁাদের আলো পুরো উঠানকে আলোকিত করে রেখেছে। গাছের উপরে সে আলো পড়ে ছায়াগুলো রং তুলি দিয়ে আল্পনা অঁাকছে। এ গাছ থেকে ও গাছে পাখির ঝাপটানিতে মাঝেমধ্যে মনের মধ্যে ভয় জাগিয়ে তোলে। টিনের চালের উপর দিয়ে দৌড়ে কাঠবিড়ালি নারকেল গাছের নারকেল ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে সাদা বক উড়ে হয়তো তাদের নীড়ে ফিরছে। মায়াবী শরতের স্নিগ্ধ জোৎস্না হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। হঠাৎ করে শিয়ালের হঁাকে এশার মনে ভয় লাগিয়ে দিল। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে বসল। সন্ধ্যায় উঠানে বসেই সে কথা বলে ঠিক করে নিল আগামীকাল নৌকা নিয়ে কোথায় কোথায় যাবে এবং কি করবে। এশার কথার মাঝখানে তার মা স্কুল বন্ধ করে মামার বাড়িতে আসার অভিযোগ তুলেছে। মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই সে বলছে এটা হচ্ছে আমার শরতের ছুটি।