বাবার আদশর্

প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

মোহাম্মদ অংকন
রাব্বি গ্রামের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। প্রতিদিন বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যায়। স্কুল ছুটি হলে আবার দল বেঁধে বাড়ি ফেরে। বিকালে পাড়া-মহল্লায় খেলতে যায়। সাঝ হলে বাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসে। এভাবেই তার প্রতিটি দিন কাটে। মাঝেমধ্যে সে তার বাবার সঙ্গে গ্রামের হাটে যায়। হাট থেকে ফেরার সময় রাব্বির বাবা তাকে খাওয়ার জন্য চকোলেট, রুটি, লজেন্সসহ নানা ধরনের জিনিস কিনে দেন। শুধু এসবই কিনে দেন না। প্রতিবার হাট থেকে দু’একটা করে চারাগাছও কিনে দেন। তার বাবার গাছ লাগানোর দারুণ নেশা। যেখানে একটু ফঁাকা জায়গা দেখেন, সেখানেই তিনি গাছের চারা লাগান। সঠিক পরিচযার্র মাধ্যমে চারাগুলোকে বড় গাছ করে তোলেন। এতেই তিনি থেমে থাকেন না। কোথাও খঁাচায় বন্দি পাখি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে শিকারিদের বুঝিয়ে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। অসচেতন শিকারিরা তার কথা মানে। ‘আমরা আর পাখি শিকার করব না। আমরা বুঝতে পারি নাই।’ রাব্বির বাবার এসব কাজ তার খুবই ভালো লাগে। রাব্বির বাবার মতোই অনেকটা তার মা। সে তার মাকেও দেখে, বাড়ির আশপাশে বিভিন্ন শাক-সবজির বাগান করছেন। ঘরের সীমানায় ফুলের গাছ লাগাচ্ছেন। সংসারের কাজের ফঁাকে ফঁাকে এসবের পরিচযার্ করছেন। এসব কাজে রাব্বির বাবা বরাবরই সমথর্ন দেন স্ত্রীকে। একদিন সকালে রাব্বি ঘুম থেকে উঠে দেখে তাদের বাড়িতে একজন ডাক্তার এসেছেন। সে ঘর থেকে বের হয়েই বুঝতে পারল, তার বাবা ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার মহোদয় তার চিকিৎসা করছেন। এমন দৃশ্য দেখে তার মনে ভয় জাগে। সারাটি দিন বিষণœতায় কাটে। বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় কেউ কেউ বলল, ‘রাব্বী রে, তোর বাবা মনে হয় আর বেশি দিন বঁাচবেন না। তোর বাবা না থাকলে তোর অনেক কষ্ট হবে রে, তাই না?’ বন্ধুদের মুখ থেকে এমন কথা শুনে তখন সে কঁাদতে কঁাদতে তার বাবার কাছে ছুটে আসে। ‘বাবা, ওরা আমাকে এসব কথা বলছে?’ তার বাবা তাকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ধুর পাগল, আমার কিছুই হয়নি। আমি ঠিক আছি। ওরা না বলে ওসব। দুষ্টুমি করেছে।’ এসব কথা তাকে বলতে বলতে নীল জামার পকেট থেকে কয়েকটা কয়েন বের করে রাব্বিকে দিয়ে বলেন, ‘বাজান আমার, দোকান থেকে চিপস, লজেন্স কিনে খেও। আর কারও সঙ্গে দুষ্টুমি করিও না। সঁাঝবেলা পড়তে বসিও।’ রাব্বি বাবার স্নেহ পেয়ে যেন আনন্দে মনটা ভরিয়ে তোলে। খেলাধুলা করতে আবার বন্ধুদের কাছে ছুটে যায়। রাব্বিদের অভাবের পরিবার। সত্যই তার বাবা গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর মতো পযার্প্ত টাকা তার বাবার নেই। কিন্তু উপায় কী এখন? রাব্বির বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, তার চিকিৎসার জন্য বাড়ির আঙিনার গাছগুলো বিক্রি করে দেয়ার। এবং তিনি ঠিক তাই করলেন। চিকিৎসার জন্য বাড়ির আঙিনার পুরনো ও নতুন গাছগুলো বিক্রি করে দেয়া হলো। এতেও সব টাকা জোগাড় না হওয়ায় তার বাবা কয়েকজন প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ঋণ নিলেন। অতঃপর তার বাবা শহরে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করালেন। চিকিৎসা করানোর পরও রাব্বির বাবা কখনো সুস্থ থাকেন, আবার কখনো অসুস্থ হয়ে যান। বাবার এমন অবস্থা দেখে তার মা-ও যেন দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। অভাবের সংসারে আত্মীয়-স্বজনের দেয়া টাকায় ওষুধ-পত্র কিনে খেয়ে তার বাবার দিনগুলো অতিক্রম হতে থাকে। রাব্বির বাবা অসুস্থ; তারপরও তিনি গাছ লাগাতেন। আর তিনি স্বপ্ন দেখতেন, ‘এই গাছগুলো আমার ছেলের অভাবের সময় কাজে লাগবে। যেমন করে পুরাতন গাছগুলো আমার টাকার জোগান দিয়েছে।’ গাছের কাছে দঁাড়িয়ে দঁাড়িয়ে বলতেন, ‘তোরা বেঁচে থাক। তোরাই আমার ভবিষ্যৎ।’ বছর ঘুরে ঈদ এলো। ঈদে নতুন পোশাক নেয়া রাব্বির কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। আর তার সে স্বপ্ন পূরণে মামারা তাকে টাকা দিলেন। টাকা দেয়ার পর মামারা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাব্বি, ঈদে নতুন জামা-কাপড়, জুতা কিনেছ কী?’ তখন রাব্বি ওসব কিছু না কিনেই বলল, ‘হ্যঁা মামা, আমি সব কিনেছি।’ তার এমনটা বলার একটাই কারণÑ ঘরে তার অসুস্থ বাবা রয়েছে। প্রতিদিনই ওষুধের জন্য টাকা লাগে। সে ঈদে পুরাতন পোশাক পরেই নামাজ আদায় করতে গেল। তার অসুস্থ বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সে ঈদগাহ্ মাঠে নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে বাড়িতে এসে মায়ের হাতে রান্না করা লাচ্ছা-সেমাই খেয়ে দারুণ একটা ঈদের আমেজ উপভোগ করে। আর বিকাল হলেই বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। ঈদের দিন তার বন্ধুরা নতুন নতুন জামা, প্যান্ট ও জুতা পরে ঘুরে বেড়ায়। আর রাব্বি তার বাবার দেয়া ১৫-২০ টাকা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেয়। তার কোনো কোনো বন্ধু বলল, ‘কি রে রাব্বী, ঈদে কি নতুন পোশাক কিনিস নাই? এই জামা, প্যান্ট তো তুই প্রতিদিনই পরিস!’ লজ্জায় রাব্বি বলল, ‘আমি আগামী ঈদে কিনবো রে। প্রতি ঈদেই নতুন পোশাক কিনতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আর নতুন পোশাকের সঙ্গে ঈদের কোনো সামঞ্জস্য নেই।’ ঠিক এভাবেই রাব্বির ঈদের দিনটা কেটে যায়। কিন্তু ঈদের রাতে ঘটে এক মমাির্ন্তক ঘটনা। রাব্বির বাবা পৃথিবী থেকে না ফেরার দেশে চলে যায়। তার বাবার অকাল মৃত্যুতে সে যেন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। উচ্চৈঃস্বরে কান্না করতে থাকে। সবাই তাকে সান্ত¡না দেয়। ‘দেখ রাব্বি, কারও বাবা কখনো চিরদিন বেঁচে থাকে না। একদিন আমাদেরও চলে যেতে হবে। ধৈযর্ ধরো। তোমার মা-তো বেঁচে আছে।’ তারপর, মাসের পর মাস কেটে যায়। রাব্বি তার বাবা বেঁচে থাকার দিনগুলো প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখে। তার বাবার কথাগুলো কানে এসে ভাসে। যেন তার বাবা বলছেন, ‘খোকা, তুই আমার লাগানো গাছগুলোর পরিচযার্ করিস। যেখানে একটু ফঁাকা জায়গা দেখবি, সেখানেই গাছ লাগাবি। আর পশু-পাখিকে কখনো কষ্ট দিবি না।’ রাব্বি যেন এসব ভেবে ভেবে অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু পারিবারিক দৈন্যতা তাকে থামিয়ে দেয়। সে চিন্তা করে, ‘কবে আমি বড় হবো?’ পরক্ষণে সে ভাবে, ‘আমি বড় হলে, আমিও আমার বাবার মতো গাছপালা লাগাবো। পশু-পাখিকে ভালোবাসব। আমি আমার বাবার আদশের্ক বুকে লালন করে বেঁচে থাকতে চাই। সবুজে দেশকে ভরিয়ে দিতে চাই।’