একটু জানো

বাংলা নামের দেশ

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

শেখ একেএম জাকারিয়া
নূহ (আ.)-এর দুই পুত্র। হাম ও শাম। প্রথম পুত্র হামের ছয় পুত্র- হিন্দ, সিন্ধ, হাবাম, জানয়, বারবার, মিউবাহ। তাদের মধ্যে যিনি যে অঞ্চলে বাস করেন, তার নামানুসারেই সে জনগোষ্ঠীর নাম হয় এবং তাদের অধু্যষিত এলাকাও তাদের নামের স্বাক্ষর বহন করে। এভাবেই হিন্দ বা হিন্দুস্তান, সিন্ধ বা সিন্ধু ইত্যাদি জাতি ও অঞ্চলের নাম হয়। হিন্দের চারপুত্র- পূরব, বঙ, দকন, নাহারাওয়াল। হিন্দের ২য় পুত্র বঙ পূর্বাঞ্চলে বসতি স্'াপন করেন। বঙ-এর বংশধরদের আবাসস্'লই বঙ্গ নামে পরিচিত। উলেস্নখ্য 'বঙ' যে এলাকায় শাসন করতেন সে অঞ্চলটি ছিল জলাভূমি। তাদের কৃষিকাজের সুবিধার জন্য জমির চারপাশে উঁচু আল বেঁধে পানি সরানো হতো। বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আল যুক্ত হয়ে বঙ্গাল শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। আবার বঙ্গ নামকরণের পেছনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পৌরাণিক কাহিনীও বিদ্যমান। পৌরাণিক কাহিনী মতে, বঙ্গের নাম এসেছে রাজা বালির পুত্রের নাম থেকে। সেখানে দাবি করা হয়, রাজা বালির এক পুত্র 'অঙ্গ' শাসন করতেন 'পশ্চিমবঙ্গ, খুলনা ও বরিশাল' অঞ্চল। আরেক পুত্র 'বঙ্গ' শাসন করতেন 'ঢাকা, ময়মনসিং ও ত্রিপুরা' অঞ্চল। এবং সর্বশেষ পুত্র 'পুন্ড্র' শাসন করতেন 'উত্তরবঙ্গ ও আসাম' অঞ্চল। রাজা বালির পুত্রদের নামানুসারেই তাদের শাসনকৃত অঞ্চলগুলো অঙ্গ, বঙ্গ ও পুন্ড্র নাম লাভ করেছে। এ ছাড়া বঙ্গের নামতত্ত্ব নিয়ে আরও অনেক বিতর্ক আছে। এখন আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি কীভাবে বঙ্গ থেকে বাংলা নামটি এলো। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ব্যাখ্যা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তার মতে, বাংলা শব্দের উচ্চারণ হয়েছে বঙ্গ থেকেই, যেটি মূলত ছিল একটি সংস্কৃত শব্দ। আর্যরা নাকি অঞ্চলকে বঙ্গ হিসেবে অভিহিত করত। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে বসবাসকারীরা বঙ্গর সঙ্গে ফার্সি 'আল' প্রত্যয় যোগ করে, যাতে শব্দটির নতুনরূপ দাঁড়ায় বাঙাল বা বাঙ্গালাহ্‌। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আইন-ই-আকবরীর রচয়িতা ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের উক্তি টেনে বলেন, 'মুসলমান শাসনামলে বিশেষ করে ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে এবং ১৫৭৬ সালে মোগলরা বাংলা দখল করার পর এ অঞ্চলটি বাঙাল বা বাঙ্গালাহ্‌ নামেই পরিচিতি পায়। তবে বাংলা, বাঙাল বা দেশ-এই তিনটি শব্দের কোনোটিই বাংলা শব্দ নয়। এগুলো ফার্সি ভাষা থেকে এসেছ্তে সর্বপ্রথম বাঙ্গালা শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় মিনহাজের পরবর্তী ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারণীয়র লেখায়। পরে ঐতিহাসিক শামস-ই- সিরাজ আফীফ, সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহকে 'শাহ-ই- বাঙ্গালা', 'সুলতান-ই- বাঙ্গালা' শাহ-ই-বাঙ্গালিয়া বলে আখ্যায়িত করেন। মোগল সম্রাট আকবরের অন্যতম সভাষদ আবুল ফজল তার 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্'ে 'বাঙ্গাল' বা 'বাঙ্গালা' নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি চমৎকার কাহিনী বিবৃত করেছেন। তার মতে, এদেশের প্রাচীন নাম বঙ্গ। এদেশের জমিতে উঁচু আল বাঁধা হতো। বঙ্গ এবং আল এ দুটি শব্দ যোগে বাঙ্গাল এবং পরবর্তীকালে বাঙ্গালা হয়েছে। বঙ্গ শব্দের আভিধানিক অর্থ জলাভূমি। প্রাচীনকালে এ জলাভূমিতে রাজারা ১০ গজ প্রশস্ত, ২০ গজ উঁচু বিশাল আকৃতির আল নির্মাণ করতেন। বর্তমানেও বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুরের অনেক স্'ানে 'বাঙলা' শব্দটি জলাভূমিতে 'বাঁধ' দেওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলা জলপস্নাবন ও বৃষ্টির দেশ, বাংলার সঙ্গে তাই আল (বাঁধ)-এর গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। আবার অনেকে ধারণা করেন, বঙ্গ শব্দের সঙ্গে 'রক্ষক' বা 'অধিবাসী অর্থবোধক 'পাল' শব্দযোগে সমাস নিষ্পন্ন 'বঙ্গপাল' শব্দ সৃষ্ট হয়েছে এবং তারই তদ্ভব রূপ 'বঙ্গাল'। কারও কারও মতে বঙ্গদের আলয় অর্থাৎ বঙ্গ জাতির আবাসভূমি অর্থে 'বঙ্গাল' শব্দের সৃষ্টি। এর পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাকে বিভিন্ন নাম দেন। -চলবে যেমন- বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার, আসামের মতো কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত সাম্রাজ্যের নাম দিয়েছিলেন 'বঙ্গ'। ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলের নাম হয় 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি'। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পুরো বাংলায় একটা প্রশাসনিক বিভাজন হয়। বাংলার পশ্চিম অংশ হয়ে যায় 'পশ্চিম বঙ্গ' এবং পূর্ব অংশ হয়ে যায় 'পূর্ব বাংলা'। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে বঙ্গপ্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। ৪৭-এ দেশভাগ হওয়ার পর পূর্ব বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশ হলো, তখন থেকে এর নামকরণ নিয়ে এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এর নাম 'পূর্ব পাকিস্তান' করার চেষ্টা করে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কাগজে-কলমে যদিও 'পূর্ব বাংলা' নামটিই ছিল, কিন্তু 'পূর্ব পাকিস্তান' নামকরণের তৎপরতাও জারি ছিল। দুঃখের কথা, এর কিছুদিন পরেই অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের ১৪ অক্টোবর 'পূর্ব বাংলা' নামটি পরিবর্তন করে সরকারিভাবে 'পূর্ব পাকিস্তান' রাখা হয়। এরপর ১৯৫৭ সালে করাচিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ বাঙালি সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় 'পূর্ব পাকিস্তান' নামটির প্রতিবাদ করে বলেন, 'স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা পূর্ব বাংলার স্থলে 'পূর্ব পাকিস্তান' বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের পূর্ব বাংলা ব্যবহার করতে হবে। 'বাংলা' শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তা হলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা, সে জন্য গণভোট নিতে হবে। 'এরপর আসে ১৯৬৯ সাল, শুরু হয় আইয়ূব পতন আন্দোলন। সে সময় গণঅভু্যত্থানে একটি স্স্নোগান নিয়মিতই দেওয়া হতো- 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' অর্থাৎ এ অঞ্চলকে অনেকেই মনে-প্রাণে 'বাংলাদেশ' হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এই বাংলাদেশ নামটি হয়তো উনিশ শতকের সাহিত্য থেকে এসেছে। কেননা, উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে বলা হতো- বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে বঙ্গদেশ শব্দের উলেস্নখ আছে। কাজী নজরুল ইসলাম তিরিশের দশকে তার কবিতায় বাংলাদেশ নামটি ব্যবহার করেছেন। আবার সত্যজিতের চলচ্চিত্রেও উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশ নামটি। 'বাংলাদেশ' নামের দাবি পাকাপোক্ত হয় ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি ভাষণের পর থেকে। যারা পূর্ব পাকিস্তান নামটি বদলাতে চাচ্ছিলেন তাদের যুক্তির ছিল, 'যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে গেছে এবং প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সাবেক প্রাদেশিক নাম পুনর্জীবিত হচ্ছে, তাই পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত প্রদেশের নাম আর 'পূর্ব পাকিস্তান' রাখা সঙ্গত হবে না।' পরে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুসহ অপরাপর নেতারা এ অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। যেমন স্বাধীন পূর্ব বাংলা, বাংলা, বেঙ্গল, ইস্ট বেঙ্গল, বঙ্গ, বঙ্গদেশ এবং বাংলাদেশ। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অর্ধেকের বেশি নেতাকর্মীই ছিলেন বাংলাদেশ নামটির পক্ষে। শেষে বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবিত বাংলাদেশ নামটিই সবাই একবাক্যে মেনে নেন। 'কারাগারের রোজনামচা' বইয়ে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার কথা উলেস্নখ আছে। ওইদিন আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ''একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র 'বঙ্গোপসাগর' ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।' বাংলাদেশ নাম রাখার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, '১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে- বাংলা। এর পর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে- দেশ। এই দুটি ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে 'বাংলাদেশ' নামকরণ করা হয়।'' এর পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এ অঞ্চলের নাম 'বাংলাদেশ' নামকরণের খবর ছাপা হয় এবং আতাউর রহমান খান 'পাকিস্তান অবজার্ভার'-এ বঙ্গবন্ধুর এই নামকরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন। এ ছাড়া ন্যাপের আধ্যাত্মিক গুরু মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর প্রকাশ্য জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের পুনঃনামকরণ সমর্থন করে বলেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে 'বাংলাদেশ' নামকরণই হবে ঠিক এবং যথার্থ। তিনিও যুক্তি দেন, যেহেতু এক ইউনিট ভেঙে গেছে, তাই 'বাংলাদেশ' নামটি পুনরুজ্জীবিত হওয়া উচিত। এর পর থেকে নথিপত্রগুলোয় পূর্ব পাকিস্তান লিখতে হলেও কেউ মুখে পূর্ব পাকিস্তান উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন বাংলাদেশ। সবাই এ অঞ্চলকে বাংলাদেশ হিসেবেই মনে-প্রাণে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে, তাতেও বলা হয়- এই দেশটির নাম হলো 'বাংলাদেশ'। তা ছাড়া কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণায়ও স্বাধীন দেশের নাম বাংলাদেশ-ই উলেস্নখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রম্নমুক্ত হয় এবং বিজয় লাভ করে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সে সময় দেশটির সাংবিধানিক নাম দেওয়া হয় 'বাংলাদেশ'। এভাবেই আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম 'বাংলাদেশ' নামটি পাই এবং সারাজীবনের জন্য বাংলাদেশ নামটি আমাদের হয়।