মুমুর দলবল

প্রকাশ | ২৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

হালিমা রিমা
মুমু আজ বিকালে সবাইকে আসতে বলেছে স্কুলের মাঠে জরুরি সভা করার জন্য। বেশ কিছুদিন ধরে সবাই বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। তাদের এলাকায় একের পর এক পোষা কুকুর-বেড়াল গায়েব হয়ে যাচ্ছে। তাই আজ রুমি, টিনা, রফিক, যতীন, তিন্নি, গফুর, মিনা সবাই মিলে বিষয়টা আলোচনা করে দেখবে। প্রথমেই তিন্নির কালো হুলো বেড়ালটা গায়ের হয়। পরে গফুরের কুকুর ভোলা তারপর মুমুর কুকুর কিটি। আবির একটু ভিতু প্রকৃতির আর মাকে ছাড়া কোথাও যায় না। আজ আবির নিজেই দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির। এসেই ভ্যঁা কান্না জুড়ে দিল। সবাই জানতে চাইল কি হয়েছে বল। এতে আবিরের কান্না আরও বেড়ে গেল। এবার মুমু ধমক দিয়ে বলল আহা বল কি হয়েছে আর আমাদের সভায় কান্নাকাটি করা যায় না। এবার যা বলল তার সারমমর্ হচ্ছে আবিরের খরগোশটাকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। মুমু সব শুনে গম্ভির হয়ে গেল। তার মানে শুধু কুকুর-বিড়াল নয়, পোষা সব প্রাণীর দিকেই চোরের নজর। এবার তিন্নি বলল, চোরটাকে পেলে সবাই মিলে মজাটা বুঝিয়ে দিতাম। আমি ক্যারাটে ক্লাসে কিছু টেকনিক শিখেছি চোরকে নাস্তানাবুদ করে দিব আমি একাই। মুমু তিন্নিকে থামিয়ে দিয়ে বলল আগে তো চোরকে পেতে হবে তারপরে না। আর আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হয় না আমার আঙ্কেল বলেছে। আমরা চোরকে ধরে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিব। দলের সবচেয়ে ভাবুক এবং ভীতু হলো রফিক সে বলল আচ্ছা এমন তো নয় ভ‚ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারপর তাদের রক্ত খাচ্ছে। এই কথা শুনে গফুর আর আবির কঁাদতে লেগে গেল। মুমু এবার সবাইকে ধমকের সুরে বলল যারা সভার নিয়ম ভাঙবে তাদের সভা থেকে বের করে দেয়া হবে। সভায় অপ্রয়োজনীয় কথা বলা আর কান্নাকাটি নিষিদ্ধ। এবার বেশ গম্ভীর স্বরে মুমু বলল, আজ থেকে আমরা সবাই বাড়ির আশপাশে নজর রাখব। তারপর যতীনের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার বাসায় একটা ময়না আছে না। তুমি সাবধানে থাকবে আর পাখিটাকে নজরে রাখবে। যতীন চোখ গোল গোল করে তোতলাতে তোতলাতে বলল কি...ব...ল আ...মা...র ম...ইয় ...না! মুমু ছাড়া সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। যতীন ভয় পেলে তোতলাতে থাকে। এবার মুমু বিরক্ত হয়ে সবার দিকে তাকাল। সবাই সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল। মুমু সবার দিকে তাকিয়ে বলল আমরা দুদিন পর আবার বসব। আজ আবার সবাই মিলে বসেছে। আবির সবার আগে এসে উপস্থিত। আস্তে আস্তে সবাই এসে পড়ল শুধু যতীন আসেনি। তিন্নি বলল সে একজন জটাধারী গেরুয়া পোশাক পরা সাধু দেখেছে তার বাড়ির পাশে পর পর দুদিন; আগে যাকে কোনোদিন দেখা যায়নি। এবার যতীন আসল তার চোখ-মুখ লাল। এসেই বলল আজ দুপুর থেকে তার ময়না গায়েব। সারাদিন ময়নাটার সঙ্গেই ছিল। দুপুরে যখন গোছলে গিয়েছিল তখন তার মা ছিল বাড়ির কাজে ব্যস্ত। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে খঁাচার দরজাটা খোলা আর ময়নাটা গায়েব। মুমু সব শুনে বলল আর কেউ কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখেছ। রফিক বলল ইদানীং পাড়ার পাগলীটা বেশি ঘুর ঘুর করে। আর তার ইয়া বড় একটা ঝোলা আছে। মুমু সব শুনে বলল তবে কাল যেহেতু সবার স্কুল বন্ধ আমরা সকালে একসঙ্গে হয়ে চল জটাধারী সাধুকে আর পাগলীটাকে অনুসরণ করি। সবাই একমত হয়ে বাসায় চলে গেল। পরেরদিন সবাই মাঠে খেলার নাম করে বাসা থেকে বের হলো। ওরা সবাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ওরা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি দলে মুমু, যতীন, টিনা, মিনা আর অন্য দলে তিন্নি, গফুর, রুমি ও আবির। মুমুর দল জটাধারী ভিক্ষুককে আর তিন্নির দল পাগলীটাকে অনুসরণ করবে বলে ঠিক করল। তিন্নিরা কিছুক্ষণ পরই পাগলীটাকে দেখতে পেল। সবাই একটু দূর থেকে অনুসরণ করতে লেগে গেল। ওরা দেখল পাগলীটা কিছুদূর গিয়ে তার ঝোলা খুলে রাজ্যের ফেলে দেয়া জিনিস বের করতে লাগল, তারপর সে আপনমনে খেলতে লেগে গেল। কিছুক্ষণ পর গাছের তলায় ঘুমিয়ে গেল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ওরা জটাধারী ভিক্ষুককে দেখতে পেল না। তাই সবাই বাসার দিকে রওনা হলো। যতীন বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ জটাধারীর সন্ধান পেল। দেখল ইয়া বড় গেঁাফ, চোখ দুটি টকটকে লাল, গলায় শামুকের মালা, হাতে লাঠি আর মাথায় লাল লাল লম্বা চুলের জটা। যতীন সাহস করে পিছু নিল। দেখল জটাধারী কাছেই জঙ্গলে ঢুকে গেল। যতীন আরেকটু এগোতেই আচমকা জটাধারী পিছন ফিরে তাকাল। আর যায় কোথায়! যতীন ওরে বাবারে বলে দিল এক দৌড়। আর পিছন ফিরে তাকায়নি। পরেরদিন ওরা আবার এক সঙ্গে হলো। তিন্নির দল তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানালো। যতীন হন্তদন্ত হয়ে এসেই বলতে শুরু করল। সে বলল, ‘জটাধারী তার দিকে যখন তাকিয়েছিল তখন তার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল। আরেকটু দেরি হলেই সে আগুনে পুড়ে যেত। আর জটাধারী একটা ভ‚ত থাকে ও কাছের জঙ্গলের শ্যাওড়া গাছে।’ সঙ্গে সঙ্গে রফিক বলল... বলেছিলাম না ভ‚তের কাÐ। মুমু সব শুনে বলল তবে আজ চল সবাই মিলে জঙ্গলে যাই দেখি কেমন ভ‚ত! রফিক ভয়ে ভয়ে বলল আমি যাব না যতীনও সুর মেলালো। এবার মুমু বলল ‘দেখ আমরা সবাই আমাদের পোষা প্রাণীকে ভালোবাসি আর সবাই চাই আমাদের প্রিয় পোষা প্রাণীকে ফিরে পেতে। তাই ভেবে বল কে কে যাবে আর আমরা এক সঙ্গে থাকলে ভ‚তও কিছু করতে পারবে না।’ এবার সবাই যাবে বলে মনস্থির করল। বিকালের আলো থাকতেই সবাই রওনা হয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। অনেকদূর হেঁটে ভিতরে গিয়ে একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেল। ওরা পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে দুজন মানুষের কথা শুনতে পেল। কেউ একজন বলছে সব আয়োজন শেষ এখন একটা মানুষের বাচ্চা লাগবে। তাহলেই আমরা যজ্ঞ শুরু করতে পারব। দেখবি যেন বাচ্চাটি একমাত্র সন্তান হয়। বেড়ার ফঁাক দিয়ে তাকিয়ে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কারণ সবার পোষা প্রাণীকে তারা দেখতে পেল। শুনে সবার গায়ে কঁাটা দিয়ে উঠল। মুমু সঙ্গে সঙ্গে রফিককে বলল কাছের থানায় আর বাবা-মাকে বিষয়টা জানাতে। রফিক ভয়ে তখন আধমরা। মুমুর ধমকে আর কিছু না বলে জোরে বাড়ির পথে হঁাটা দিল। মুমু বলল, আমরা দুজন দুজন করে ভাগ হয়ে যাব যাতে একটা দল ধরা পড়লে অন্যদল সাহায্য করতে পারি। মুমু আর যতীন একদলে আর তিন্নি টিনা দ্বিতীয় আর রুমি আবির এক সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। মুমু আর যতীন একটু এগিয়ে গেল। হঠাৎ যতীনের ময়না যতীনকে দেখেই ডাকা শুরু করল ‘যতীন যতীন বস বস’। সঙ্গে সঙ্গেই জটাধারী আর তার সাগরেদ ওদের দুজনকে দেখে ফেলল। ওরা দৌড় দেয়ার আগেই ওদের ধরে ফেলল। সাগরেদটা যতীনকে দেখিয়ে বলল বাবা এই ছেলেটা একমাত্র সন্তান। চলেন একে বলি দিই। আর মেয়েটাকে নিয়ে পরে ভাবা যাবে। যতীন বলি দেয়ার কথা শুনেই ভয়ে শিশি করে দিল। মুমুও খুব ভয় পেয়ে গেল যদিও বিষয়টা বুঝতে দিল না। জটাধারী সাধু বলল তোরা এখানে কেন এসেছিস? মুমু সাহসের সঙ্গে বলল ছোটদের সঙ্গে তুই করে কথা বলছেন কেন? সাধু বিকট স্বরে কেঁপে কেঁপে শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল। এবার বলল বিচ্ছু দুটাকে বেঁধে ফেল শক্ত করে। এবার সব প্রাণীদের সঙ্গে যতীনকে কপালে সিঁদুরের ফেঁাটা দিয়ে দঁাড় করিয়ে দিল। তারপর যতীনকে দুধ দিয়ে গোছল করিয়ে সাদা আলখেল্লার মতো পোশাক পরিয়ে দিল। যতীনের নাকে কিছু একটা ধরতেই যতীনের চোখ লাল হয়ে গেল কেমন যেন বেসামাল ভাবে হঁাটছিল। মুমু তাড়াতাড়ি চিন্তা করতে লাগল কীভাবে ওদের কাজে দেরি করিয়ে দেয়া যায়। এরপর যতীনকে এবং সব প্রাণী এক সঙ্গে রেখে হিম গলায় বিড় বিড় করে পিশাচ সাধু মন্ত্র পড়তে লাগল আর কিছুক্ষণ পর পর লাল রঙের কিছু ছিটিয়ে দিচ্ছিল সবার দিকে। মুমু হঠাৎ জোরে চিৎকার করে বলতে লাগল তিন্নি, আবির, টিনা সবাই যাও পাড়ার সবাইকে ডেকে নিয়ে আস। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থাকা সবাই দিল এক দৌড়। অনেক পায়ের আওয়াজে পিশাচ আর তার সাগরেদ ভয় পেয়ে গেল। পিশাচ এসে মুমুর গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। আর মুখটা শক্ত করে বেঁধে দিল। সাগরেদটা বাইরে দেখার জন্য দৌড় দিল কিন্তু কাউকে ধরতে পারল না। এবার পিশাচ সাধু বলল তাড়াতাড়ি কর আমরা বলি দিয়েই এখান থেকে কেটে পড়ব। বলি দেয়া হয়ে গেলেই আমি হব সবর্শক্তির অধিকারী। এবার সাধু ঠিক পিশচের মতো করে হাসতে লাগল। মুমু দ্রæত চিন্তা করে নেয়। কিন্তু তার হাত-মুখ সব শক্ত করে বঁাধা। মুমু পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাথর পা দিয়ে সজোরে লাথি দিয়ে দিল সাধুর গায়ে। ঠিক সাধুর কপালে লেগে কপালটা কেটে গেল। সাধু আ. শব্দ করে কপাল চেপে ধরল। দুষ্ট সাধুর কপাল দিয়ে রক্ত পড়ছিল তখন। এবার সাধু মুমুকে আঘাত করতে গেল। মুমু পা ছুড়তে লাগল। ঠিক তখনই রফিকের সঙ্গে পুলিশ আঙ্কেলরা ঢুকে পড়ল। পুলিশ পিশাচ সাধু আর তার সাগরেদকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে গাড়িতে তুলল। পাড়া-প্রতিবেশী আর পুলিশ মুমু ও তার দলকে অনেক বাহŸা দিল। সবাই তাদের প্রিয় প্রাণীকে পেয়ে খুব খুশি। যতীনকে হাসপাতালে নেয়া হলো। একদিন পরই সে সুস্থ হয়ে ফিরে এলো। পরেরদিন পত্রিকায় ওদের সাহসিকতার গল্প ছবিসহ ছাপা হলো। এভাবেই মুমু ও তার বন্ধুরা সফল হয়েছিল। এক সঙ্গে মিলে কাজ করলে অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব।