মাকড়সা ও টিকটিকি জ্যোৎস্নালিপি

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

জ্যাৎস্নালিপি
একটি ঘরে বাস করত একটি মাকড়সা আর একটি টিকটিকি। কিন্তু দুজনের কারও মধ্যেই কোনো ভাব ছিল না। সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকত। মাকড়সা ঘরের মধ্যে জাল বুনতো আর টিকটিকি সুযোগ পেলেই সেটা লুকিয়ে ভেঙে দিত; মাকড়সা টের পেত না। টিকটিকি মনে মনে বলত, ভারি মজা তো। এমনি করেই দিন কাটতে লাগল। একদিন মাকড়সা পণ করলÑ যে এই কাজ করে, তাকে ধরতেই হবে। তারপর জাল তৈরি শেষ হলে একটা বইয়ের তাকের পেছনে লুকিয়ে রইল সে। টিকটিকি লেজ নেড়ে গুটি গুটি পায়ে চলে আর আশপাশে তাকায়। তারপর মাকড়সার বোনা জালটি চোখের পলকে নষ্ট করে দেয়। এরপর যেই না পালাতে যাবে, অমনি মাকড়সা তার সামনে এসে দঁাড়ায়। টিকটিকির চোখমুখের অবস্থা তখন দেখার মতো। সে ভীত গলায় বলল, টি-ক টি-ক মানে, তু তু তুমি! মাকড়সা রেগেমেগে বলল, তাহলে এতদিন তুমিই আমার কষ্ট করে বানানো জাল নষ্ট করেছ। এমনিতেই সব সময় আমার পেছনে লেগে থাকো। আবার পেছনেও আমার ক্ষতি করো। টিকটিকি বলে, ঠিক ঠিক। মাকড়সা চোখ গোল করে বলে, চিঁ চিঁ চিঁ মানে, তুমি একটা দুষ্টু। তোমার শাস্তি হওয়া উচিত। টিকটিকি বলে, ঠিক ঠিক। মাকড়সা এবার ভাবতে শুরু করে কী করে টিকটিকিকে শাস্তি দেয়া যায়? কিন্তু ভেবে কিছুই পায় না। তারপর সে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। টিকটিকি কদিন মাকড়সাটিকে না দেখে তার আর ভালো লাগে না। মনে মনে বলে, তোর পেছনে লাগতে না পারলে জীবনে একটুও মজা নেই। সপ্তাহ খানেক পরে মাকড়সা নিজের জায়গায় ফিরে আসে। কিন্তু কেমন চুপচাপ। টিকটিকি বলে, কোথায় গিয়েছিলে এতদিন? তুমি ছাড়া আমার থেকে মজা নেই। খেয়ে মজা নেই। ঘুমিয়ে মজা নেই। আর তোমার সঙ্গে কথা না বললে তো আমার চলেই না। টিকটিকি এবার বলে, তা এতদিনে ভালোই তো আরাম-আয়েশে ছিলে? আরাম কোথায় দেখলে? তুমি ছাড়া কি আমার আরাম হয় বলো! আমাকে বিরক্ত করাতেই তো তোমার সুখ, সে তো আমি জানি। এবার তাহলে তোমায় ছেড়ে আমায় যেতেই হয়। না, না, যেও না। আমি আর তোকে বিরক্ত করব না। ভয় দেখাব না। এভাবে এক-দুদিন যেতে না যেতেই মাকড়সাকে আবার বিরক্ত করা শুরু করে টিকটিকি। কখনো পিঁপড়ে ছেড়ে দেয় গায়ের ওপর আবার কখনো জাল ছিঁড়ে দেয়। মনের দুঃখে মাকড়সা আবার উধাও হয়ে যায়। সে এই বাড়িটির বন্ধ একটা ঘরে বাস করা শুরু করে। এখানে মনের সুখে জাল বানায়। জালে পোকামাকড় এসে পড়ে, সেগুলো মনের আনন্দে ধরে ধরে খায়। কেমন করে যেন টিকটিকিটি খেঁাজ পেয়ে যায়Ñ মাকড়সা কোথায় আছে। সে এও জেনে যায়, মাকড়সা বড় একটা জাল তৈরি করছে। টিকটিকির আর তর সয় না, সে মনে মনে ফন্দি অঁাটে, যে করেই হোক জাল ছিঁড়তে হবে। এ কদিনে ভালো ভালো খাবার খেয়ে মাকড়সাটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, তাই সারাদিন তার শুধু ঘুম পায়। এক দুপুর বেলায় খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল মাকড়সা। তখন টিকটিকি সেই ঘরে ঢুকে বলে টিক টিক টিক। মাকড়সা ঘুম ঘুম চোখে বলে, আমি টিকঠাক। তুমি এখানে কেন? তোমায় তো আমি ডাকিনি। আরে ডাকতে হবে কেন, আমি নিজেই তোমার খেঁাজ নিতে চলে এলাম। এবার খুব বিরক্ত হয়ে মাকড়সা বলে, আচ্ছা এসেছো যখন বসো, গল্প করে চলে যাও। টিকটিকি এদিক-ওদিক তাকায় আর গল্প করে। তার মন খারাপের কথা জানায়। গল্প ফুরাতেই চায় না তার। পরদিন দুপুরে মাকড়সা খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছে। টিকটিকিও মনে মনে ভেবে রেখেছে, মাকড়সা ঘুমালেই জাল নষ্ট করতে হবে। গুটি গুটি পায়ে সে জালের দিকে এগোয় আর ফিরে ফিরে চায়। টিকটিকি তখন গভীর ঘুমে। টিকটিকি এগিয়ে যায় জালটার দিকে। আর যেই না সে জালটার মধ্যে পা দিয়েছে অমনি তার পা আটকে যায় মাকড়সার বানানো জালে। মাকড়সা আসলে এতক্ষণ চুপিচুপি দেখছিল, দুষ্টুটা কী করে! সে অলস কণ্ঠে বলে, কে? এখানে কী করছে? টিকটিকি কঁাদোকঁাদো গলায় বলে, এই দেখো না, তোমার জাল নষ্ট করতে যাওয়ায় আমার কী দশা! নিজের জালে নিজেই আটকা পড়েছি। আমায় বঁাচাও ভাই। ভাই! তুমি আবার আমায় ভাই হলে কবে থেকে! তুমি থাকো জালে আটকা, আমি এখন আমার নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছি। এতদিন আমায় খুব জালিয়েছো এখন মজা বোঝ। টিকটিকি জালে বন্দি থাকে আর মাকড়সা তার আগের ঘরে ফিরে যায়। মাকড়সা আপন মনে গান গায় আর জাল তৈরি করে। সেই জালে পোকা এসে পড়ে, সে সেগুলো ধরে ধরে খায়। বেশ আরামেই দিন কাটতে থাকে তার। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই আর ভালো লাগে না তার। একা একা থাকা যায় নাকি! এটা কোনো জীবন হলো। তার তখনই মনে হয় টিকটিকিটির কথা। মনে মনে বলে, আহা রে, টিকটিকিটি তো পুরনো ঘরে জালে আটকা পড়ে আছে, কাজটা মোটেও ঠিক করিনি আমি, যতই হোক প্রতিবেশী তো। সে না হয় আমার ক্ষতিই করছে, তাই বলে আমাকেও তাই করতে হবে। মাকড়সা ছুটে যায় পুরনো ঘরটির দিকে। এদিকে না খেয়ে খেয়ে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে টিকটিকি। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। মনে মনে খুবই অনুতপ্ত সে। সে বুঝতে পেরেছে যে, কারও ক্ষতি করা উচিত নয়। কিন্তু জীবনই তো তার বঁাচে না, মাকড়সার কাছে ক্ষমা চাইবে কী করে! আর কখনো কী দেখা হবে মাকড়সার সঙ্গেÑ যখন সে একথা ভাবছিল আর সে সময়ই মাকড়সা এসে জাল থেকে মুক্ত করে তাকে। বলে, আমায় ক্ষমা করে দাও, আমার উচিত হয়নি তোমায় এভাবে রেখে যাওয়া। টিকটিকি বলে, তুমি তো ঠিক কাজই করেছ। আমি তোমায় কত বিরক্ত করেছি। ঠকিয়েছি। না গো তোমায় ছাড়া আমারও ভালো লাগে না। এতদিনে আমিও সেটা বুঝতে পেরেছি। তারপর অসুস্থ টিকটিকিকে খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ করে তোলে মাকড়সা। এখন দুজনেরই ভারি ভাব। টিকটিকি ছোট ছোট পোকামাকড় ধরে মাকড়সাকে খেতে দেয় আর মাকড়সা টিকটিকির গায়ে হেঁটে হেঁটে দুষ্টুমি করে। এখন আর টিকটিকি তার জাল নষ্ট করে না। দুজনে এখানে-ওখানে বেড়াতে যায়। টিকটিকি জানালার পদার্র পাশে লুকিয়ে বলে, টিক টিক। মাকড়সা পদার্র পেছন দিক দিয়ে হেঁটে হাত টিকটিকির লেজে নাড়া দিয়ে বলে, চিঁচিঁ।