সাপের গাঁও

প্রকাশ | ১৫ মে ২০২২, ০০:০০

মিজান আকন্দ
গ্রামের প্রতিটি বাড়ির পাশেই আছে ঝোপঝাড়, পতিত জমির বুক জুড়েও রয়েছে ঝোপঝাড় আর জঙ্গল, গ্রামের পেছনের কবরস্থানেও একই অবস্থা। এসব জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে বহু সাপের বসবাস। তাছাড়া মানুষের বসতভিটায় ইঁদুরের গর্তে কিংবা গোয়ালঘরে বাঁশ ও কাঠের ফাঁকে বাসা বেঁধে সাপ ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়। সহজে এরা মানুষের চোখের সামনে পড়তে চায় না। মাঝেমধ্যে ঝোপঝাড়ের পাশে কিংবা জমির আলে সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখা যায়। মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায়, সাপও তেমনি মানুষকে ভয় পায়। তাই সাপেরা দিনের বেলা বের না হয়ে রাতের বেলা চলাচল করে। ভুল করে কখনো দিনের বেলা বের হলে, মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে সাপ মারতে উদ্যত হয়। কবরস্থানে একটি শতবর্ষী দাড়িওয়ালা সাপ আছে, সে নাকি কখনো কোনো মানুষকে ক্ষতি করে না। তাকে সর্পরাজ মনে করা হয়। এক ধরনের সাপ গাছের ডালে ঝুলে থাকে, তারা পাখির বাসায় গিয়ে পাখির বাচ্চা খেয়ে ফেলে। জঙ্গলে দুমুখো সাপও আছে- যারা দুই দিকেই চলতে পারে। কিছু সাপ আছে খুব ভয়ংকর ও প্রচন্ড জেদি! গোখরা এদের মধ্যে অন্যতম। গোখরা যখন ফণা তুলে ফোসফাস করে, তা দেখে ভয়ে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়! তবে অকারণে সাপ কাউকে আক্রমণ করে না। কোনো সাপকে যদি কেউ আঘাত করে- তাতে যদি সাপটির মৃতু্য না হয়, তাহলে নাকি আঘাতপ্রাপ্ত সাপটি যেভাবেই হোক আঘাতকারী ব্যক্তিকে দংশন করবে! এক জাতের সাপ আছে- রাতের বেলা গোয়ালঘরে ঢুকে গাভীর দুধ পান করে চলে যায়। সাপের ভয়ে গাভী তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই গ্রামে সাপ নিয়ে লোকমুখে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এমন অদ্ভুত গল্প শুনে প্রচন্ড ভয় লাগে, আবার শুনতেও ইচ্ছে করে। একদিন একটি ছোট্ট শিশু উঠোনে বসে পানির পাত্র নিয়ে খেলা করছিল। তখন একটি তৃষ্ণার্ত সাপ এসে সেই পাত্র থেকে পানি পান করতে থাকে। অবুঝ শিশুটি না বুঝে সাপের মাথায় থাপ্পড় দিতে থাকে। সাপটি অবুঝ শিশুর ওপর একটুও রাগ না করে পানি পান শেষে জঙ্গলে চলে যায়। এ ঘটনা শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে! যদি শিশুটিকে ছোবল দিয়ে দিত! বছরে দু'একবার গ্রামে সাপুড়ে আসে সাপ ধরতে। তাছাড়া কারো বসতভিটায় সাপ থাকলে সাপুড়ে ডেকে আনা হয়। তারা এসে ধুলো পড়া দেয়, মন্ত্র পড়ে, বীণ বাজায়, তখন অনেক সাপ বেরিয়ে আসে। তারা বড়ো বড়ো সাপগুলো ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় সবাইকে সাপ মারতে নিষেধ করে যায়। তবুও মাঝেমধ্যে সাপ মারা পড়ে। একদিন প্রায় ছ'ফুট লম্বা একটা পদ্মগোখরো মারা পড়ে। এই মৃত সাপটি দেখে ভয়ে সবাই শিউরে ওঠে! মরে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ তার লেজটা নড়তে থাকে। এ সময় দুধু কবিরাজ এসে হাজির হয়। সে যখন হাত দিয়ে ধরে সাপটিকে উপরে তোলে, চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই ভয়ে দূরে সরে যায়। সাপের মাথায় দড়ি দিয়ে বেঁধে যখন গাছের ডালে ঝুঁলিয়ে দেয়, তখন সাপটিকে অনেক লম্বা মনে হয়! তারপর ছুরি দিয়ে সাপের চামড়া ছাড়িয়ে নেয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাই কবিরাজের কীর্তি দেখে, যদিও এই দৃশ্য কারো কাছেই নতুন কিছু নয়। এরপর সাপটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে মাছের মতো টুকরো টুকরো করে একটি হাড়িতে নিয়ে জ্বাল দেবে। এর থেকে তেল সংগ্রহ করে, তা দিয়ে বাত- ব্যথাসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করবে। তার এহেন কর্মকান্ড সবার জানা। জ্বাল দেয়া সাপের হাঁড়ি চুলাতে রেখে জরুরি কাজে কবিরাজ বাইরে যায়। এর মধ্যে তার ছেলে কালু ঘরে ঢুকে; সে খেতে খুব পছন্দ করে, ঘরে ঢুকেই তার কিছু মুখে দেয়া চাই-ই। গরম গরম মাছ ভাজা খেতে সে খুব পছন্দ করে। চুলার হাঁড়িতে দৃষ্টি যেতেই তার জিভে জল এসে যায়। মুহূর্তেই অর্ধেকের বেশি পেটে চালান করে দেয়। এমন সময় কবিরাজ ঘরে ফিরে আসে। বাবাকে দেখে ছেলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। হাঁড়িতে সাপের টুকরো এত কম দেখে কবিরাজ চিৎকার করে বলে, কালু কি করেছিস তুই? দূর থেকে চেচিয়ে কালু বলে, বাবা আমি সবগুলো মাছ খাইনি, তোমাদের জন্যও রেখেছি! কবিরাজ মাথায় হাত দিয়ে বলে, একি করেছিস তুই! খুব দ্রম্নত এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যে কালু সাপের মতো জেদি আর ভয়ানক হয়ে ওঠে। গ্রামের ছেলেরা কালুকে সাপের মতো ভয় পায়!