রাসেলের জন্য কষ্ট

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

সুব্রত চৌধুরী
মধ্য আগস্টে ভোরের সূর্যটা রক্তিম আভা ছড়িয়ে নতুন আরেকটা দিনের আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছিল ঠিকই, কিন্তু সে আগমনী বার্তায় ছিল না সুন্দরের রিনিকিঝিনিকি সুর, ছিল অসুন্দরের করুণ রাগিণী। স্কুলের পথে রাস্তায় নামতেই ব্যথার করুণ রাগিণী সৌম্যের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে বেশিক্ষণ লাগল না। সদর রাস্তায় পৌঁছতেই সাঁই সাঁই ছুটে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ তার কানে ব্যথার করুণ রাগিণী হয়েই বাজলো। সৌম্য খেয়াল করল পথে লোকজনের আনাগোনা অন্য দিনের চাইতে অনেক কম, বলতে গেলে প্রায় জনশূন্য। রাস্তার দু'পাশের সব দোকানপাটের ঝাঁপও বন্ধ। সদরঘাট কালীবাড়ী পেরিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে আসতেই চেনা শহরটাকে সত্যিই সৌম্যর অচেনা মনে হলো। সৌম্যর চোখে পড়লো রাস্তার মোড়ে জলপাই রংয়ের জিপে ধাতব নল উঁচিয়ে শ্বাপদদের সতর্ক দৃষ্টি, জলপাই রংয়ের ট্রাক ভর্তি শ্বাপদদের কঠিন চেহারাও তার নজর এড়ালো না। সৌম্য ত্রস্তে পা চালিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেখল কলাপসিবল গেটে বড় তালা। সৌম্য মনে মনে হিসাব মেলাতে চেষ্টা করল, কিন্তু কোনোভাবেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারল না। সে আর সাত পাঁচ না ভেবে বাসার পথে পা বাড়াল, চলার পথে গলির মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট জটলা পাকানো লোকজনের ফিসফিসানি তার কানে এলো। জোরে জোরে পা চালিয়ে সৌম্য যখন বাসার গেটে এসে পৌঁছাল তখন দেখল উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে মা তার ফেরার অপেক্ষায়। মা তাকে অনেকটা ছোঁ মেরে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে গেটটা বন্ধ করে দিল। মা'র অস্বাভাবিক আচরণে সৌম্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? আগে ঘরে ঢোক। তোমাকে খুব টেন্সড মনে হচ্ছে। হঁ্যা টেনশনে আছি। কেন? কী হয়েছে? দেশের অবস্থা ভালো না। কী হয়েছে মা? বঙ্গবন্ধুকে ওরা মেরে ফেলেছে। কারা? শ্বাপদরা। রেডিওতে শোন। সৌম্য মনোযোগ দিয়ে গম্ভীর গলায় রেডিওতে ক্ষণে ক্ষণে ঘোষণাগুলো শুনতে লাগল। তা শুনতে শুনতে দেওয়ালে টাংগানো বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে একদৃষ্টে সে তাকিয়ে থাকল। নিজের অজান্তেই তার দু'চোখ লোনা জলে ভরে গেল। হঠাৎ বাসার সদর দরজায় দুমদাম আওয়াজের শব্দ শুনে সৌম্যর মা হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলতে গেল। মা দরজার খিল খুলতেই এক ঝটকায় মাকে ঠেলে ছোটকা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। নিজের ঘরে ঢুকে ছোটকা ইতস্ততভাবে পায়চারি করতে লাগল, আর বিড়বিড় করে কী যেন আওড়াতে লাগল। সৌম্য পেছন পেছন ঢুকে ছোটকাকে জিজ্ঞেস করল, বঙ্গবন্ধুকে ওরা মেরে ফেলেছে, এখন কী হবে ছোটকা? কী হবে আবার? দেশটা জাহান্নামে যাবে। তোমরা কিছু করবে না ছোটকা? আই মিন প্রতিবাদ.... অবশ্যই করব, সৌম্যর মুখের রাঁ কেড়ে নিয়ে ছোটকা বলল। কখন? আজ সন্ধ্যায়। আমিও তোমার সঙ্গে প্রতিবাদে শামিল হবো ছোটকা। না, না, তুই ছোট মানুষ। ওরা তো আমার মতো ছোট রাসেলকেও হত্যা করেছে, আমি রাসেল হত্যার প্রতিবাদ করব, বিচার চাইব। তোর মা পারমিশন দিলে তো? মাকে আমি ম্যানেজ করব, তুমি চিন্তা কর না। দুপুরে খাবার টেবিলে সৌম্য মাকে বলল, মা একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না তো? বলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ছোটকারা আজ সন্ধ্যায় প্রতিবাদ মিছিল বের করবে, আমিও সেই প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হবো। না, না, তুমি ছোট মানুষ, তোমার ওসবে না জড়ালেও চলবে। মা ওরা আমার বয়সি রাসেলকেও হত্যা করেছে, আমি রাসেল হত্যার বিচার চাইব মা। না, তোমাকে ঘরের বাইরে যেতে হবে না। দেশের অবস্থা ভালো না। মায়ের বারণ শুনে সৌম্য মাকে আর ঘাঁটালো না। কারণ বরাবরই সে মায়ের বাধ্য, কখনো সে মায়ের অবাধ্য হয়নি। \হসৌম্য খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো ঘরের বাইরে না গিয়েও কীভাবে প্রতিবাদ করা যায়। এক সময় সে একটা উপায়ও বের করে ফেলল। মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে, এক সময় সন্ধ্যা নামে। সৌম্য ছোটকার ঘরে উঁকি মারে, ছোটকার টিকিটিও মেলে না। সৌম্য নিশ্চিত হয় ছোটকা প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে গেছে। সৌম্য ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে প্রতিবাদী স্স্নোগান, 'মুজিব হত্যার বিচার চাই, বিচার চাই, বিচার চাই।' সৌম্য আর এক মূহূর্ত দেরি না করে নিজের ঘরে গিয়ে একুশে ফেব্রম্নয়ারি বাড়ির ছাদে সে যে কালো পতাকাটা উত্তোলন করে সেটা নিয়ে দৌড়ে ছাদে উঠে গেল। ইথারে ভেসে আসা স্স্নোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সৌম্য কালো পতাকাটা দুই হাতে আকাশ পানে তুলে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল, 'রাসেল হত্যার বিচার চাই, শিশু হত্যার বিচার চাই।' চিৎকার করতে করতে দু'ফোঁটা লোনা জল সৌম্যর দু'চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।