আমাদের ভূগোল স্যার

প্রকাশ | ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

রুমানা নাওয়ার
আমাদের ভূগোল স্যার। আবু তাহের চৌধুরী। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। হাঁটেনও লম্বা লম্বা পা ফেলে। মাথাভর্তি কালো চুল। গায়ের রংটা শ্যাম বর্ণ। কিন্তু চেহারাটা ভারী মায়াবী। ধবধবে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট থাকতো স্যারের পরনে। একজন আদর্শ টিচারের পোশাক যেন এরকমই হয়- এটাই মনে হতো তাকে দেখে। স্যার যখনি ক্লাসে যেতেন একটা ইয়া সাইজের লম্বা বেত থাকত হাতে। ওই বেত দিয়ে স্যার কখনো আমাকে মেরেছেন মনে পড়ে না। তবে বেতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাঁটতেন নাড়াচাড়া করতেন। পড়ার জন্য না খেলেও একবার দেরিতে ক্লাসে আসার অপরাধে প্রচন্ড মেরেছিলেন। আমি, এনি, আর আরজুকে। সেই থেকে ভূগোল স্যার বলতেই ভয় পেতাম। স্যারের পড়া না পারলে আস্তে কোমল স্বরে বলতেন- হাতটা দাওতো দেখি। তারপর শপাং শপাং বেতের আওয়াজ। স্যার ক্লাসে ঢুকলেই পুরো ক্লাস পিনপতন নীরবতা। চেয়ারে বসতেন না তিনি মোটেও। সামনে রাখা টেবিলটায় আলতো করে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। তাই পুরো ক্লাসটাই স্যারের চোখেচোখে থাকত। নো নড়াচড়া, নো সাইডটক। সবাই মনোযোগী ছাত্র সেজে মুখটাকে সিরিয়াস করে ভূগোল আয়ত্ত করতাম। বইটাও ধরতেন দুই আঙুলের ফাঁকে করে। এটা ছিল তার নিজস্ব একটা স্টাইল। একলাইন পড়তেন তো দশবার বুঝাতেন। আর মুখে থাকতো মৃদু মৃদু হাসি। পড়ার ফাঁকেফাঁকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন স্যারের বিশেষ ঢংয়ে। যাকে প্রশ্ন করবেন তার সামনে দাঁড়িয়ে- মাথায় ভূগোল বইটা দিয়ে একটা টোকা দিয়ে বলতেন- তুমি বলতো দেখি। আর মুখজুড়ে থাকতো স্যারের মুচকি মুচকি হাসি। পড়া যারা পারত না তাদের ভীষণ ভয়ের কারণ ছিলেন স্যার। লম্বা বেতটাকে কাজে লাগাতেন তখন। দেখি হাতটা দাওতো দেখি- বলে চিকন বেতের বারিতে কাহিল হওয়ার দশা। স্যার কিন্তু মুচকি হাসিতে অমলিন। বেশি না দু'চার ঘা। এতেই প্রতিটি অমনোযোগী ছাত্রছাত্রী কুপোকাত। তর্জন গর্জন হুঙ্কার এসব ভূগোল স্যারের সঙ্গে করা যেত না। বেমানান। স্যার ধীরস্থির শান্ত মেজাজের। বিশাল স্কুলের প্রধান হয়ে ও বিষয় শিক্ষক হওয়া তা মেইনটেইন করা। যাবতীয় দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করা। গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয়ে প্রাত্যহিক পাঠদান আমাদের ভূগোল স্যারের জন্য কিছুই না। মনে হতো সব একহাতে সামলান তিনি। লম্বা লম্বা পা ফেলে নারায়ণ হাটবাজার, স্কুল প্রকারন্তরে কলেজিয়েট স্কুলের এ মাথা থেকে ও মাথা দাপিয়ে বেড়াতেন আমাদের ভূগোল স্যার। শপাং শপাং বেতের বাড়ি পড়তো তাদের হাতে ও পিঠে। হাতে ধরা ভূগোল বইটাও কম কাজে আসত না-স্যারের। দু'আঙুলের ফাঁকে ধরা বইটা দিয়ে কপাল বরাবর বাড়ি মারতেন দুচারটা। তাতেই কপালের অবস্থা বারোটা বেজে যেত। বামহাতে বই ডান হাতে বেত। আর পড়া ধরার সময় স্যারের একটা চোখ বন্ধ করে পড়া ধরতেন। ক্লাসের লম্বা ছাত্র গৌতম। তাকে আগে ধরত পড়া। ও ক্লাসে না থাকলেও ডেকে বলতেন- গৌতম্যা দাঁড়া। পড়া বল। অন্য স্টুডেন্টরা বলতো- স্যার গৌতম আজ আসেনি। তারপর স্যারের সেই স্বভাব সুলভ হাসি। তারুণ্য দীপ্ত সময়ে আমরা স্যারকে পেয়েছি। জীবনের অফুরান গান অফুরান সম্ভাবনা তাদের চোখেমুখে। শুধু আমাদের না পারলে গোটা বিশ্বকেই বদলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা ধ্যানে জ্ঞানে। বদলে দেওয়ার মূলমন্ত্র তাদের মনে। প্রিয় ভূগোল স্যারের মতো আরও কিছু শিক্ষক আমাদের আলোর পথের সন্ধান দিয়েছেন। কত হাজার হাজার ছাত্র তারই হাতধরে আজ প্রতিষ্ঠিত। দেশ ও দশের কল্যাণে নিবেদিত।