ঘুম থেকে উঠেই বাতাবি লেবুর ছোট্ট গাছটির পাশ দিয়ে হাঁটছিল সিয়াম। বাতাবি লেবু গাছের দিকে চোখ পড়তেই খুশিতে নেচে উঠল সে। সিয়ামের হইচই দেখে ছুটে এলেন জমির চাচা।
জমির চাচা বাগানের মালি। বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানটির তিনিই পরিচর্যা করেন। কোমর থেকে গামছা খুলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে সিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
-কী দেখছো বাজান? জমির চাচা জানতে চান।
-চাচা দেখুন না, বাতাবি লেবুর পাতায় দু'টো প্রজাপতির ছানা। কী সুন্দর তুলতুলে!
জমির চাচা ভালো করে দেখে বললেন, প্রজাপতির বাচ্চা তো দেখলাম না। উড়ে গেল নাকি?
-না চাচা, প্রজাপতির ছানারা উড়তে পারে না। তারা গাছের পাতার মধ্যেই বসে থাকে। পাতা খায়। এই যে দেখুন, সবুজ রংয়ের দু'টি প্রজাপতির ছানা। সিয়াম আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এবার চাচা খেয়াল করলেন, বাতাবি লেবুর সবুজ পাতায় সবুজ রংয়ের দু'টি পোকা। বসে বসে পাতা খাচ্ছে। পাতার রংয়ের সঙ্গে মিশে আছে ও দু'টোর গায়ের রং। ভালো করে না দেখলে বোঝাই যায় না পাতায় আদৌ কিছু আছে কিনা!
জমির চাচা বললেন, তুমি ভুল করছো বাজান। এগুলো এক ধরনের পোকা। গাছের পাতা খেয়ে শেষ করে দেয়। গাছের ক্ষতি করে। তাই আমি এগুলো দেখলেই ফেলে দিই। মাঝে মাঝে কীটনাশক ওষুধ দিলেও এগুলো মরে যায়।
\হ-চাচা, প্রজাপতি স্তূপাকারে ডিম পাড়ে গাছের পাতায়। সেই ডিম থেকে শুঁয়াপোকা বা শূককীট হয়।
তারপর জমির চাচাকে হাত দিয়ে দেখালো সিয়াম, এগুলো হচ্ছে শূককীট। কিছুদিন পর এরা মূককীটে পরিণত হবে। তখন এরা কিছু খাবে না। তার সপ্তাহখানেক পর এগুলো পূর্ণ প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসবে।
জমির চাচা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সিয়ামের দিকে।
-চাচা বিশ্বাস করুন। আমি বইয়ে পড়েছি। আপনি বাবার কাছ থেকেও জেনে নিতে পারেন।
সিয়ামের কোনো কথাই জমির চাচার বিশ্বাস হলো না। তার কাছে রূপকথার গল্পের মতো মনে হলো। পাতাখেকো একটা পোকা কীভাবে প্রজাপতি হবে! পাখা আসবে কোথা থেকে? সবুজ রংয়ের একটি পোকাই বা কীভাবে রংবেরংয়ের প্রজাপতি হবে? চাচার মাথায় এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খেল কিছুক্ষণ। তারপর বাতাবি লেবুর পাতা থেকে পোকাগুলো ফেলে দিতে চাইলে সিয়াম চাচাকে অনুরোধ করল- চাচা, এরা গাছের পাতা খেলেও গাছের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। আপনি এদের মেরে ফেলবেন না পিস্নজ। দেখবেন এরা প্রজাপতি হয়ে এ বাগানেই উড়ে বেড়াবে।
এবার সিয়ামের কথার গুরুত্ব দিলেন জমির চাচা। তবে মনের ভেতর বিশ্বাস আনতে পারলেন না। তাই তিনিও উৎসাহ নিয়ে দেখতে চান, সিয়ামের কথাগুলো আসলে সত্যি কিনা, নাকি নিছক কল্পকথার গল্প।
এখন থেকে প্রতিদিন ভোরেই সিয়াম বাগানে যায়। প্রজাপতির ছানাদের বেড়ে ওঠা দেখে। একদিন ভোরে সে দেখল, একটি ছানা শূককীট থেকে মূককীটে পরিণত হলো। দেখে সিয়ামের সেকি আনন্দ! জমির চাচাকে ডেকে এনে দেখালে তিনিও বিস্ময়ে দেখলেন। মূককীটটি পাতার নিচের অংশে ঝুলে আছে। মনে হচ্ছে ওটার মাঝখানে কেউ যেন চিকন সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
তার দু'দিন পর অন্য ছানাটিও মূককীটে পরিণত হলো। এটাও জমির চাচা বিস্ময়ভরা চোখে দেখলেন।
এভাবে সপ্তাহখানেক কেটে গেল। একদিন ভোরে সিয়াম বাগানে গিয়ে দেখল একটি মূককীটের খোলসটুকু শুধু ঝুলে আছে, প্রজাপতি নেই। মন খারাপ হয়ে গেল তার। জমির চাচাকে দেখাল সে। চাচা বিশ্বাস করলেন না। একটি পোকা বা কীট প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেছে- না দেখে এ কথাটি বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।
চাচা বললেন, পোকাটিকে কোনো পাখি এসে খেয়ে গেছে হয়তো। সিয়াম অনেক যুক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও চাচাকে বোঝাতে পারছে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবই শুনলেন সিয়ামের বাবা।
তিনি দু'জনকে চমৎকার একটি বুদ্ধি দিলেন। বাবার বুদ্ধি দু'জনেরই মনে ধরল। বাবার কথা অনুযায়ী জমির চাচা বাতাবি লেবু গাছের চারপাশে চারটি খুঁটি দিয়ে বড়ো একটি মশারি টানিয়ে দিলেন।
সিয়াম মনে মনে খুব খুশি। যেভাবেই হোক জমির চাচাকে বিশ্বাস করাতেই হবে। প্রজাপতির জীবনচক্র সম্পর্কে চাচার ধারণাকে পাল্টে দিতে হবে।
তিন দিন পর। সকালবেলা। জমির চাচা ডাকলেন সিয়ামকে। সিয়াম ছুটে গেল বাগানে। চোখ বড়ো বড়ো করে সে দেখল মশারির ভেতর কালোয় লাল সাদা মেশানো একটি প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে আর পাতার নিচে তার খোলস ঝুলে আছে।
জমির চাচা ছোট্ট সিয়ামের কথা বিশ্বাস করলেন। সিয়াম তার বই থেকে প্রজাপতির জীবনচক্রের ছবি দেখাল জমির চাচাকে। অভিভূত হয়ে চাচা দেখলেন আর আলস্নাহর সৃষ্টির নৈপুণ্যতার প্রশংসা করে বলে উঠলেন- 'সুবহানআলস্নাহ'।
তার ক'মাস পরের ঘটনা।
একদিন ঘুম থেকে উঠে সিয়াম দেখল বাগানজুড়ে শত শত প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। চাচা মুচকি হেসে বললেন, এখন আমি প্রজাপতির ছানাদের যত্ন করি। ওরা আদর পেয়ে বাগান ছেড়ে কোথাও যায় না।
সিয়াম খুশিতে কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করল প্রজাপতিদের পেছনে। প্রজাপতিতে ভরে গেছে বাগান। সিয়ামদের বাগান এখন শুধু ফুল-ফলের বাগান নয়, প্রজাপতির বাগানও।