মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

রাফির একটা শীতের সকাল

নুসরাত রীপা
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

খুব শীত পড়েছে কয়েকদিন যাবত। সুয্যিমামা ঢাকা পড়ে আছে ঘন কুয়াশার আবরণে। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে রাফি। সামনের রাস্তাটা আজ বেশ ফাঁকা।

আজ ছুটির দিন বলেই হয়তো রাস্তাটা আরও বেশি খালি। এমন শীতে খুব প্রয়োজন না থাকলে কে-ই বা বাইরে বেরোয়।

রান্না ঘর থেকে খিচুড়ির মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। মা সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। বাবা আজ বাড়ি নেই। গ্রামের বাড়ি গেছে কী সব জমিজমার কাজে। বাসায় কেবল রাফি, মা আর দিদা।

শীতের সকালে গরম গরম সবজি খিচুড়ি রাফির খুব প্রিয়। ভাবতে ভাবতেই খোলা জানলা দিয়ে এক ঝলক তীব্র শীতল বাতাস ঘরের ভেতর বয়ে গেল।

হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে জানলাটা বন্ধ করে দিল রাফি। বাপরে! কী ঠান্ডা। এখন কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়তে হবে- বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে।

ঠিক এ সময় ঘরে ঢুকলেন মা।

রাফি, কী করছিস বাবা?

কিছু না।

তাহলে যা তো। নিচের দোকান থেকে ডিম নিয়ে আয়। খিচুড়ি করেছি। ডিম ভাজি দিয়ে নাস্তা দেব।

মা। শুধু খিচুড়িই দিয়ে দাও। যা শীত। বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

মা শীতল চোখে একবার রাফির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে। তাহলে আমি যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দে।

রাফি টুপ করে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে বলে, টাকা দাও। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।

রাফি এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। যথেষ্ট বড় হয়েছে। এত বড় ছেলে বাসায় থাকতে মা দোকানে যাবে কষ্ট করে, এটা মোটেও ঠিক না।

টাকা নিয়ে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল রাফি। বাসার উল্টোদিকেই রাস্তার পাশঘেঁষে বেশ কয়েকটা দোকান। কয়েকটা মুদি দোকান, ফটোকপি, বিকাশ, একটা চা সিঙ্গারা আরও কী কী সব। মিম এন্টারপ্রাইজ নামের দোকান থেকেই রাফিদের বেশির ভাগ কেনাকাটা হয়। বাসা থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে দ্রম্নত ডিম কিনে ফিরে আসতে গিয়েই একটা দৃশ্যে চোখ আটকে যায় তার। তাদের বাসার সিঁড়ির গোড়ায় বসে আছে একটা ছেলে। ছেলেটা এমনভাবে বসেছে যে দূর থেকে একটা বস্তার মতো মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই টোকাই। চুরির ধান্দায় আছে। অসাবধানে কেউ সিঁড়ির দরজা একটু খুলে রাখলেই টুপ করে ভেতরে ঢুকে যাবে আর সুযোগমতো চুরি করে পালাবে। এসব ঘটনা পত্রপত্রিকাতেই পড়েছে রাফি। তাই সে সরাসরি ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়ায়।

এই কে তুই? এখানে কী করিস?

বলতে বলতে রাফি খেয়াল করে ছেলেটা নিতান্তই শিশু। নয়/দশ বছর হবে বয়স। পরনের লাল ময়লা গেঞ্জিটা পা পর্যন্ত টেনে গোল হয়ে বসে আছে। কাপড়ের মতো সারা মুখেও ময়লায় মাখামাখি। এলোমেলো চুলগুলো লালচে ধুলোভরা।

রাফিকে দেখে ছেলেটা ভীত চোখে উঠে দাঁড়ায়।

এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছিস কেন? রাগি রাগি কণ্ঠে রাফি প্রশ্ন করে।

ছেলেটা নাকের জল টানতে টানতে বলে,

চুরি করতে আসিনি। কাগজ টুকাইতে বের হইছিলাম। শীতে হাঁটতে পারতাসি না। এজন্য এইখানে এট্টু বসছি। এইখানে বাতাস আসে না। বলে উবু হয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকা পলিথিন টা তুলে নেয়।

রাফি দেখে ছেলেটার হাফপ্যান্ট টাও ছেঁড়া। ময়লা, ফাটা পায়ের চামড়া। গোড়ালিতে রক্ত জমাট। তার মনে কষ্টের উদয় হলো।

ছেলেটা বলে, যাইতাসিগা। মাইরেন না।

মারব কেন? থাক।

নাহ। কাগজ টুকাই গিয়া। নাহইলে খামু কী। ছুটু ভাইটা ক্ষুধা লাগলে কান্দে। রাত থেইকা কানতাছে- কাইল শুধু একটা কইরা বন রুটি খাইছি। কাগজ বেশি টুকাইতে পারিনি। শীতের লাইগা।

তোমার বাবা-মা নেই?

মা মইরা গেছে। আব্বায় পঙ্গু। গাড়ির নিচে পইড়া দুই পাও গেছে। বাড়িত থাহে। ছুডু ভাইরে দেহে। কয়দিন ভিক্ষা করছে। কিন্ত জ্বর আর কাশির লাইগা অহন বারাইতে পারে না। ডাক্তারে কইছে আব্বার বুকে ঠান্ডা জমছে। হসপিটালে ভর্তি হইতে। আমাগো তো টাকা নেই, আব্বায় হের লাইগা ওষুধের দোকানে বইলা সিরাপ খায়। কয়দিন হইল হেইডাও কিনা হয়নি।

ছেলেটার কথা শুনে রাফির অনেক মন খারাপ হয়। আহা এই শীতে তারা না খেয়ে আছে! সে বলে তুমি একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।

দারোয়ান লোকটা এতক্ষণ বাইরে কোথাও ছিল। রাফিকে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে দেখে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে, একটু বাইরে গেছি। আর অমনি ঢুইকা পড়ছে। এগুলান এত যন্ত্রণা করে। হেই ফোলা বাইর অ।

না না। ও কে থাকতে দিন। আমি উপর থেকে আসছি।

ছেলেটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, আমি যাইগা? আর এইখানে আসমু না।

রাফি বলে, ভয় পাচ্ছো কেন। একটু থাক। তারপর দারোয়ানকে বলে, ওকে যেতে দেবেন না কিন্তু। আমি আসছি- বলেই দুদ্দার করে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে আসে। মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাফির কেনাকাটা দেখেছিলেন। কিন্তু বাসায় ফিরতে দেরি দেখে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন। রাফি মায়ের হাতে ডিমগুলো দিয়ে বলল, মা, তাড়াতাড়ি কয়েকটা ডিম ভেজে দাও--- বলেই নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

আলমারি ভর্তি রাফির অনেক জামা, প্যান্ট, সোয়েটার, জ্যাকেট। কতগুলো একদম নতুন, কিছু অল্প পরা হয়েছে। আবার কিছু এখন আর পরা হয় না। কয়েকটা জামা প্যান্ট আর সোয়েটার নামিয়ে একট শপিং ব্যাগে ভরে রান্নাঘরে এল রাফি। মা বেশ কয়টা ডিম ভেজে ফেলেছেন? রাফির আগমন টের পেয়ে মাথা না ঘুরিয়েই তিনি বললেন, যা হাত ধুয়ে দিদাকে নিয়ে টেবিলে বস। আমি ডিম নিয়ে আসছি।

রাফি মায়ের কথার কোনো উত্তর দিল না। তাক থেকে একটা বক্স নামিয়ে পাতিল থেকে গরম ধোঁয়া ওঠা খিঁচুড়িতে ভরে ফেলল ওটা তারপর ওর ওপর কয়েকটা ডিমভাজি তুলে নিতেই মা দেখে বললেন, করছিস কী? বক্সে সব ভরে নিচ্ছিস। খাবি না?

মা সিঁড়ির নিচে একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে এসেছি। তুমি আর একবার রান্না কর, পিস্নজ। ওরা সবাই না খেয়ে আছে-

মা'কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে রাফি।

ছেলেটা দারোয়ানের কাছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছে। খুইলা দেন। আর আমু না। ঘরে খাওন নিয়া না গেলে ভাইটার কান্দন থামব না।

রাফি ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এতে খাবার আছে। বাসায় গিয়ে সবাই মিলে খেও। আর এই কাপড়গুলো পর শীত লাগবে না।

জিনিসগুলো হাতে নিয়ে হতভম্ব ছেলেটা, অবাক দাঁড়িয়ে আছে।

ছেলের কান্ড দেখতে মা ও রাফির পিছু পিছু নিচে নেমে এসেছিলেন। সবটা দেখে তার চোখে পানি চলে এলো। তিনি বললেন, ওকে বলেদে, কাল এসে যেন একবার দেখা করে।

ঘরে এসে রাফি বলে, মা, নাস্তা দাও।

খিচুড়ি তো সামান্য ছিল বাবা। দিদাকে দিয়েছি।

ঠিক আছে তাহলে পাউরুটি আর ডিমই দাও। তোমারটাও নিয়ে এস। একসঙ্গে খাব।

সবজি খিচুড়ি রাফির সবচেয়ে প্রিয় খাবার। ক্ষুধার্তকে সেই খাবারটা দিতে ছেলে দ্বিধা করেনি। কথাটা ভেবে রাফির মায়ের বুকটা ভরে ওঠে।

ছেলে আমার মানবিক হয়েছে, আলহামদুলিলস্নাহ। মনে মনে বলেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে