গল্প

তিতলির অসুখ

প্রকাশ | ০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০

হালিমা রিমা
তিতলির আজ কোনোভাবেই সকালে উঠে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে মনে ভাবছিল, যদি মায়ের এলার্ম দেওয়া ঘড়িটা না বাজত তো বেশ হতো। তাই কি হওয়ার জো আছে। সে জানে মা ঠিক সকাল ৬টায় তাকে ডেকে তুলবে। হলোও তাই। মায়ের চিৎকারে তার ঘুম কোথায় পালাল। খুব মন খারাপ নিয়ে উঠল। বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি দেখা গেল। সে বাথরুম থেকে বের হয়েই মুখ কাল করে মাকে বলল, 'মা আমার পেটে ভীষণ ব্যাথা করছে।' তারপর মুখে উহ্‌ আহ্‌ শব্দ করতে লাগল। মায়ের কপালে কিঞ্চিৎ চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি কোথায় ব্যথা দেখাতে বললেন। তিতলি পেটের মাঝখানে হাত দিয়ে দেখাল। মা একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, তাহলে আজ না হয় বাসায় থাক। তিতলির খুশিতে তখন চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। সে তা না করে মুখে বেদনার অনুভূতি ফুটিয়ে তুলল। সে স্কুলের ড্রামা ক্লাশে শিখেছে আবেগের কোনো অনুভূতি প্রকাশে কেমন ভংগিমা করতে হয়। নিজের অভিনয়ে সে নিজেই মুগ্ধ। এবার তিতলি আয়েশ করে বিছানায় আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল তবুও মা কিছুই বলল না। তারপর মা নরম জাউভাত কাঁচাকলা আর পেঁপে দিয়ে রান্না করে নিয়ে এলো। খাবারটার দিকে তাকিয়েই তার গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে কিছুটা খেয়েও নিল। এরপর সে তার পছন্দের টিভি চ্যানেলে কিছুক্ষণ কার্টুন দেখল। দুপুরে তার বড় ভাই স্কুল থেকে এসে মায়ের সঙ্গে স্কুলে কি কি ঘটেছে আলাপ করছিল হেসে হেসে। তিতলির মনে হচ্ছিল ভাইয়া কি অদ্ভুত কোনো দিন স্কুল বাদ দেয় না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘরে শুয়ে বসে থাকা সারাদিন টিভি দেখা কত মজার যদি বুঝত! তিতলি বিকালে বাসার সামনে খেলতে যেতে চাইলে মা বললেন, 'তিতলি সোনা আজ বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি ঘরে বসে প্রিয় কোনো বই পড়।' তিতলি প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। মনে মনে ভাবল, থাক আজ না হয় বাসাতেই থাকি। সে প্রথমে সুকুমার রায়ের কবিতার বইটি নিয়ে বসল। এটা তার সবচাইতে পছন্দের বই। তার আরও পড়তে ভালো লাগে কমিঙ্ বই। রাতে বাবা অফিস থেকে এসেই জিজ্ঞেস করলেন কয়বার টয়লেটে গিয়েছ? দুপুরে কি খেয়েছ? বাইরের খাবার একদম নয়। তিতলি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে দিল। কিছক্ষণ পর তার নানুমনি এলেন তার পছন্দের চিকেন বিরিয়ানি নিয়ে। সে মনে মনে খুব খুশি হলো। রাতে সে মায়ের কাছে বায়না করল 'মা আজ রাতে আমি ভাইয়ার মতো বিরিয়ানি খাব।' মা গম্ভীরমুখে বললেন, 'না তিতলি তোমার এসব খাওয়া চলবে না। তুমি বরং মুগ ডাল আর কাঁচা কলার ভর্তা দিয়ে নরম ভাত খাও।' তার কষ্টে প্রায় চোখে পানি চলে এল। সে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কষ্ট করে দুইবার মুখে খাবার নিয়েই উঠে গেল। সে তার রুমে চুপচাপ শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মা এসে তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, তুমি ভালো হয়ে গেলে আমি তোমায় বিরিয়ানি রান্না করে দেব। এখন ঘুমিয়ে যাও।' রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল কাল সে কি করবে তাই নিয়ে। সকালে মা এসে তার কপালে হাত রাখলেন তারপর তার চুলে আদর দিয়ে বললেন আজ কেমন আছ তিতলি? স্কুলে যেতে চাও? সে চোখ বন্ধ করেই দু'দিকে মাথা নাড়ল। মা কিছু না বলে চলে গেলেন। তিতলি সকাল ১০টা পর্যন্ত শুয়ে থাকল। মা কিছুই বললেন না। সে উঠে মাকে বলল, 'আমি নুডলস খাব।' মা কিছু না বলে তার পছন্দের খাবার বানিয়ে দিল। সে আয়েশ করে টিভি দেখতে দেখতে খাবার খেল। অন্যদিন হলে মা রাগ করতেন, আজ তাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। তিতলি আরও দুই ঘণ্টা টিভি দেখল। তারপর সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে একদল বাচ্চা খেলছিল তাই দেখছিল। তার তখন মনে পড়ল আজ স্কুলে গেমস ক্লাসে শিক্ষক তাদের ভলিবল খেলা শেখাবেন বলেছিল। ইস আজ না জানি কত মজা হচ্ছে। তার হঠাৎ বাসায় থাকতে বিরক্তিকর লাগল। সে রান্নাঘরে এসে মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মা তাও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এবার সে মাকে জিজ্ঞেস করল মা মিথ্যে বললে কি হয়? মা বললেন, 'অনেক পাপ হয়- মা। তুমি পিনোকির গল্পে কি পড়েছিলে মনে আছে?' এবার তিতলি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, মা আমার কি নাক বড় হয়ে গেছে? মা বললেন, 'তা কেন হবে- তুমি তো মিথ্যা কথা বলনি। তোমার কেন নাক বড় হবে?' তিতলি দৌড়ে আয়নার কাছে গেল। তার নিজের নাক একটু বড় বড় লাগল। দুপুরে তার বন্ধু সানভির ফোন এল। সানভি ক্লাসে কি কি হয়েছে তাকে জানাল। আজ নাকি সবাই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নাম দিয়েছে। তিতলির স্কুলে না যাওয়ার জন্য আফসোস হচ্ছিল। তার এখন খুব মন খারাপ লাগছে। নিজেকে খুব পচা মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে বাসায় শুধু টিভি দেখা, কমিক্স পড়া, শুয়ে বসে থাকা অনেক বোরিং মানে একঘেয়েমি কাজ। তার চাইতে স্কুলে যাওয়া বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসের ফাঁকে মজা করা, মাঠে খেলাধুলা করা অনেক মজার। তার আজ ড্রয়িং ক্লাশে সবাই কত কিছু শিখে ফেলেছে ভেবে আরও মন খারাপ হয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে মায়ের পেছনে এসে দাঁড়াল। মা পেছনে তাকিয়ে কিছু না বলে আবার নিজের কাজে মন দিল। এবার তিতলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, 'মা আমি স্যরি।' মা হেসে বললেন, 'কেন তিতলি সোনা?' তিতলি মাথা নিচু করে বলল, 'আমি তোমাদের মিথ্যে বলেছি; আমার কোনো পেটে ব্যথা হয়নি। আমি স্কুলে না যাওয়ার জন্য বাহানা তৈরি করেছিলাম।' মা তিতলির দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে বললেন, 'এটা আমি আজ বুঝতে পেরেছিলাম। আমি চাইছিলাম তুমি বাসায় শুয়ে বসে থাকা যে মোটেই মজার কোনো ব্যাপার নয়; তা নিজেই উপলব্ধি কর। পাশাপাশি মিথ্যা বলা খুব খারাপ। যে মিথ্যা বলে সে তার প্রিয় মানুষকে ধোঁকা দেয়। তুমি কি তাই চাও? 'তিতলি সজোরে দুইদিকে না'বোধক মাথা ঝাঁকাল। মা তিতলির কপালে চুমু খেলেন। তিতলি খুশি হয়ে বলল, 'মা আমি কালকের জন্য স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে রাখছি।' তারপর মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। আমি আর কোনো দিন মিথ্যে বলব না; কোনো দিন না।'