বাবা মানে...

প্রকাশ | ০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০

আবুল কালাম আজাদ
লুনা মিস আর সবার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। মাঝে মাঝে তিনি ক্লাশে নিয়মিত পাঠের বাইরে চলে যান। কখনো নিজেই গল্প বলেন, আবার কখনো ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে গল্প শোনেন। মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর সংক্ষেপে কিছু লিখতে বলেন। সেদিন লুনা মিস ক্লাশ ফোর-এ ঢুকে বললেন- আজ তোমাদের কোনো পড়া ধরব না। ছেলেমেয়েরা খুশি হলো। লুনা মিস বললেন, আজ তোমরা লিখবে বাবাকে নিয়ে। তোমাদের অনুভূতিতে বাবা মানুষটা কেমন তা সংক্ষেপে প্রকাশ করবে। সবাই স্বস্তি পেল। বাবা মানুষটা সবারই খুব প্রিয়- খুব আপন। বাবাকে নিয়ে কিছু লেখা মোটেও কঠিন কিছু নয়। সবাই চুপচাপ লিখতে শুরু করে দিল। মিনিট দশেক পর ফার্স্ট বেঞ্চের কোণা থেকে তপু নামের ছোট্ট ছেলেটি দাঁড়িয়ে বলল- মিস, আমার লেখা শেষ। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য সবার লেখাও শেষ হয়ে গেল। লুনা মিস তপুকে বললেন-তোমার লেখাটা পড়ে শোনাও। তপু পড়তে শুরু করল- একদিন বাবা আমাকে স্কুল থেকে নিতে এলো। যেই গেটের বাইরে বের হয়েছি অমনি শুরু হলো বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি! বাবা ছাতাটা নিচু করে আমার মাথায় ধরল। কারণ, বাবার মাথা অনেক উঁচু। দু'জনের মাথা এক সঙ্গে রক্ষা করা যাবে না। সারা পথ আমার মাথায় ছাতা ধরে বাবা ভিজে গেল। লুনা মিস বললেন, বুঝেছি, তোমার কাছে বাবা হলো মাথার ওপর নিরাপত্তার ছাতা। তারপর লেখা পড়তে দাঁড়ল মুনা। ও পড়তে লাগল- একদিন আমার খুব জ্বর হলো। বাবা তখন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে। মা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। আমিও ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাবা থাকলে খুব ভালো হতো। বাবা অফিসের কাজ ফেলে আসতে পারবে না বলে মা বাবাকে ফোনও করতে চাচ্ছিল না। শুধু শুধু চিন্তা করবে। আচমকা সে রাতেই বাবা এসে হাজির। এসেই আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার আমাকে ভালো করে দেখে ওষুধ দিলেন। আমার কী যে ভালো লাগছিল! লুনা মিস বললেন, তোমার কাছে বাবা মানে নিশ্চিন্ত থাকা। এভাবে সবাই একে একে বলে গেল কার কাছে বাবা মানে কী। লুনা মিস বললেন- বাবা মানে আমি কী বুঝি তা কি তোমরা জানতে চাও? সবাই একযোগে চিৎকার করে বলল- জি মিস, আমরা জানতে চাই। আমার কাছে বাবা মানে হলো, অহংকারে বুক ফুলে ওঠা। লুনা মিস জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। যেন আকাশে কিছু খুঁজছেন। সবাই তাকিয়ে লুনা মিস-এর মুখে। লুনা মিস আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে বললেন, আমি কখনো আমার বাবাকে দেখিনি। কখনো পাইনি বাবার আদর-স্নেহের পরশ। আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে তখন আমার বাবা যুদ্ধে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে। বন-বাঁদার, নদী-নালা, পাহাড়-জঙ্গল, প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বাবা এবং তার সহযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে থাকেন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে। একের পর এক গুঁড়িয়ে দিতে থাকেন পাকিস্তানি হায়েনাদের ক্যাম্প। দেশ যখন মুক্তির দ্বারপ্রান্তে, তখন এক সম্মুখযুদ্ধে বাবা শহীদ হোন। আমার বাবা এবং আর সব মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আমার জন্ম হয়। আমি আমার বাবাকে দেখিনি। বাবার স্পর্শ পাইনি। কিন্তু যখন বাবার কথা ভাবি, তখন সুখে ভরে যায় আমার মন। আমি একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার কাছে বাবা মানে গর্বে বুক প্রশস্ত হয়ে যাওয়া।