গল্প

মেহজাবিনের পড়ার রুটিন

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

মোকাদ্দেস-এ-রাব্বী
গিনি খালামনি এ বাড়িতে এলেই মেহজাবিন খুব খুশি হয়। অথচ আজকে ও একদম চুপচাপ। ঘরের মধ্যে এক কোণায় ঝিম মেরে বসে আছে। মেহজাবিনের মনটা খুব খারাপ। হাসি খুশি একটা মেয়ে মন খারাপ করে থাকলে মানায়? মানায় না। কাজেই মন ভালো করা প্রয়োজন ওর। আর এর জন্য গিনি খালামনিই যথেষ্ট। গিনি খালামনি মেহজাবিনের ঘরে ঢুকলো। ঢুকতে ঢুকতে বলল, মা'মনিটার কী হয়েছে? মাথা না তুলেই ও জবাব দিল, কিছু হয়নি- কিছু একটা তো হয়েছে। নইলে এত খুশি মুখটা এত গোমড়া হয়ে যায় কি করে? গিনি খালামনি জান্নাতুলের কাছে কারণ জেনেই এসেছে। পড়ার রুটিন নিয়ে সমস্যা। রুটিনটা নাকি ওর মনের মতো হয়নি। তবুও না জানার ভান করেই থাকল। জান্নাতুল হচ্ছে মেহজাবিনের আম্মু'র নাম। - কী মা'মনি, বলবে না? আবার জানতে চায় খালামনি। - কী বলব? রাশভারী কণ্ঠে বলে মেহজাবিন। -তোমার কী হয়েছে- সেটা আমার সঙ্গে শেয়ার কর। আমরা দু'জনে মিলে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব। যেন তার স্থায়ী সমাধান হয়। - কী বলব, আমি তো হলাম বকা রানী। খালি বকা খাই। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। খালি বকা দেয়। আমি আমার অধীনে নেই। আমি বকা খাওয়ার অধীনে। - এত মন খারাপ করলে এর সমাধান হবে না তো। খোলাসা করে বলো। বলে খালামনি। - আমি যাই করি, সবগুলোতে নাকি দোষ লুকিয়ে থাকে। আসলে দোষ না, বকা লুকিয়ে থাকে। রাতে ঘুমোতে যেতে একটু দেরি হলে আম্মু'র বকা। দাদির বকা। সকালে ঘুম থেকে আমি জাগার আগেই আমাকে জাগানো হয়। তাও চিৎকার আর চেচামেচি করে। ঘুম থেকে ওঠা নিয়েও কিছু না কিছু শুনতে হয়। গিনি খালামনি বলে, যেমন? - দাদি বলে, ঘুম থেকে কোনোভাবেই দেরিতে ওঠা যাবে না। ঘুম থেকে ওঠতে হবে তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি মানে এক্কেবারে ভোরবেলা।  ভোরবেলার বাতাসে ধুলাবালি থাকে না। একেবারে বিশুদ্ধ বাতাস। ভোরের বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে। এই বাতাস গ্রহণ করতে পারলে শরীর মন দুটোই ভালো থাকে। এ রকম আরও কত লেকচার।  - মা'মনি দাদি তো ভালো কথাই বলেছে। ভোরের বাতাসে তো আমাদের শরীরের জন্য আসলেই খুব উপকারী।  - তাই বলে প্রতিদিন একই রেকর্ড বাজাতে হবে? গিনি খালামনি বুঝলো মেহজাবিন খুব রেগে আছে। যে কারণে ওর সঙ্গে একটু তাল মিলিয়ে বলল, হুম! সেটাও তো কথা বটে। খালামনির একটু সাপোর্ট পেয়ে বলল, দেখ আমার একটা রুটিন আছে। সেটাও আমার অধীনে নেই। দেখ এখানে লেখা আছে মেহজাবিনের দৈনিক রুটিন। এই রুটিন আমি করিনি। আমার রুটিনেরও কোনো স্বাধীনতা নেই। দেখ এই রুটিনে লেখা আছে, পড়া পড়া আর পড়া।  গিনি খালামনি এবার একটু নড়েচড়ে বসে। মনে হচ্ছে, এবার একটু টেকনিক অবলম্বন করে মেহজাবিনকে বোঝানো যাবে। মেহজাবিনও অনেক চালাক। নিজের স্বাধীনতার কথা না বলে রুটিনের স্বাধীনতার কথা বলছে। - তোমার সঙ্গে আমি একেবারই একমত। তোমার রুটিন থাকবে তোমার অধীনে। অন্যের অধীনে কেন থাকবে? এটা মেনে নেয়া যায় না। '৭১-এ আমাদের দেশই পরাধীনতা মেনে নেয়নি। তুমি নেবে কেন? - কী করা যায় খালামনি? গিনি খালামনি বলল, চলো আমরা খালা-ভাগ্নি মিলে একটা বুদ্ধি করি। - কী বুদ্ধি? জানতে চাইলো মেহজাবিন। - তুমি একটা স্বাধীন রুটিন তৈরি কর। - স্বাধীন রুটিন মানে? - স্বাধীন রুটিন মানে, তুমি তোমার মতো করে একটা রুটিন বানিয়ে ফেলো। যে রুটিন হবে তোমার অধীনে। তোমার আম্মু'র দেয়া এই রুটিন বাতিল। - বাহ্‌! দারুণ আইডিয়া। বলেই চট করে উঠে দাঁড়ায় ও। এরপর আবার বলে, খালামনি আমি কলম-কাগজ নিয়ে আসতেছি। বলেই দ্রম্নত কলম আর সাদা কাগজ নিয়ে আসে মেহজাবিন। আগের রুটিন খুলে সামনে নিয়ে বসলো। দেখলো ঘুম থেকে ওঠার সময় লেখা আছে ভোর ৬টায়। মেহজাবিন ভাবলো ভোরের বাতাস সবারই গ্রহণ করা উচিত। দাদি এটা মন্দ বলেনি। ও আরও ১৫ মিনিট সামনে নিয়ে এলো। ও নিজেই লিখলো আমার ঘুম থেকে ওঠার সময় ভোর ৫.৪৫ মিনিট। এরপর পড়ার সময়গুলো কোথাও ৫ মিনিট কোথাও ১০ মিনিট পেছিয়ে দিল। স্কুল ও প্রাইভেটে যাওয়ার সময়টা ঠিক আগের মতোই রাখল। নিজের বিনোদন আর খেলার সময়টা বাড়িয়ে নিলো আরও ৩০ মিনিট। এভাবে পুরো রুটিনটা সংশোধন করে তৈরি করল ও নিজেই। এরপর খালামনির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, খালামনি, কেমন হলো বলো। - একদম পারফেক্ট হয়েছে। আমাকে দাও এটাকে অনুমোদন করায় নিয়ে আসি। - অনুমোদন? - হুম। এটাতে তোমার আব্বু-আম্মু'র স্বাক্ষর নিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। - বাহ্‌, তাহলে তো ভালোই হয়। বলেই খালামনি নতুন রুটিনটা নিয়ে চলে গেল আব্বু-আম্মুর ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো। ফিরে এসেই বলল, এই নাও তোমার স্বাধীন রুটিন। তোমার আব্বু-আম্মুর স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এই রুটিন স্বাধীনতা অর্জন করল। রুটিন হাতে নিয়ে খুব খুশি মেহজাবিন। ওর খুশি দেখে খালামনি বলল, শোন মামনি তোমার রুটিন এখন স্বাধীন। এটা তো ঠিক আছে! কিন্তু সেই স্বাধীনতা তোমাকেই রক্ষা করতে হবে। জানতো স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাই কঠিন। সেই কঠিন কাজটিই তোমাকে করতে হবে। আমার বাবা কর্নেল গোলাপ হোসেন। মানে তোমার বড় নানুভাই কিন্তু সেই কাজটিই করেছেন। আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তোমার বড় নানু ভাইয়ের মতো মানুষজন যুদ্ধ করেছিল বলেই। তারা যুদ্ধ করেছিল বলেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকে তোমার বড় নানুভাই সেটা রক্ষা করার চেষ্টায় সব সময় সজাগ ছিলেন। অতএব, তোমাকেও সজাগ থাকতে হবে। গিনি খালামনির এত কঠিন কঠিন কথা মাথার উপর দিয়ে গেল মেহজাবিনের। তবে ও বুঝে নিয়েছিল যে ওকেও ওর রুটিনের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। এরপর মেহজাবিন ওর রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত চলতে শুরু করল। অল্প দিনেই মেহজাবিন সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠলো। কেউ আর ওকে বকা দেয় না। দাদিও বকবক করে না। সবাই ওকে ভীষণ ভালোবাসে।