গল্প

স্বাধীনতার গল্প শুনি

প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

এনাম রাজু
স্বাধীনতা উপলক্ষে স্কুল ছুটি। আহসান কবীর ও মমতা নূর আলোচনা করছে, এই ছুটিতে তাদের একমাত্র সন্তান কাব্যকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়, এমন সময় কাব্য বলল- বাবা আমরা কোথাও ঘুরতে যাবো না। তার চেয়ে বরং তুমি বাসায় বসে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাও। আহসান কবীর বললেন- সে কি, তুমিই তো সবসময় বলো, আমি তোমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাই না। আজ আবার কী হলো? কাব্য বললো- ক্লাসের সবাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প করছিল। তুমি বলো না বাবা- মুক্তিযুদ্ধ কি? আহসান কবীর বললেন- ঠিক আছে। তোমাকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শোনাব এবং এমন একজনের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো, যিনি নিজেই একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। কাব্য বাবার কথা শুনে খুশি কতটা হয়েছে তা বুঝতে পারছে না। তবে ভেতরে ভেতরে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছে। তার কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাব্যর কাছে সুপারহিরো মনে হয়। তারা সাধারণ মানুষ নয়। তাই এমন কারও সঙ্গে দেখা হবে ভাবতেই কাব্যর মাথা ঘুরে যাচ্ছে। কাব্যের বয়স নয় বছর। বয়সের চেয়ে অনেক বেশি গুছিয়ে কথা বলতে পারে। গ্রামের অন্য দশটা বাচ্চার চেয়ে বেশি চঞ্চল ও দুষ্টু প্রকৃতির। পড়াশোনায়ও বেশ এগিয়ে। আজ স্কুল ছুটি। বাবারও অফিস ছুটি। ঢাকার রাস্তা অন্যান্য দিনের চেয়ে ফাঁকা। আহসান কবীর-মমতা, কাব্যকে নিয়ে নাশতা সেরেই চলে গেল কাব্যের এক দূরসম্পর্কের দাদুর বাড়িতে। দাদুকে দেখেই কাব্যের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল। সে হাসতে হাসতে দৌড়ে গিয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরল। কাব্যকে তার দাদুও চিনতে পেরেছে। কেননা বছর দুই আগে বিজয় দিবস উপলক্ষে এই দাদুই কাব্যের স্কুলে গল্প বলতে গিয়েছিল। স্কুলের শিক্ষক কাব্যকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ফলে সম্পূর্ণ দিনটাই সেদিন কাব্য ওর দাদুর কাছেই ছিল। কিন্তু বয়স আরও কম থাকায় তখন গল্প বোঝেনি কাব্য। তবে তার মনে আছে, সেদিন অনেকে অনেক প্রশ্ন করেছে দাদুকে। কাব্যও আজ দাদুর কাছে অনেককিছু শুনবে ভাবতেই পুলকিত হয়ে ওঠে তার মন। দাদুর সঙ্গে বাবা-মাকে একদমই কথা বলার সময় না দিয়েই কাব্য নানান প্রশ্ন করতে থাকে। তার প্রশ্নের ধরন দেখে কাব্যকে ওর দাদুর সঙ্গে বারান্দায় রেখেই ওর বাবা-মা ঘরের ভেতরে চলে যায়। আচ্ছা দাদু, সেদিন তুমি স্কুলে কী গল্প বলেছিলে? মুক্তিযুদ্ধের সময় কী হয়েছিল তার গল্প বলেছিলাম, দাদুভাই। আচ্ছা দাদু, মুক্তিযুদ্ধ হলে কী হয়? মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হলে নিজেদের একটি 'দেশ' পাওয়া যায়। কেমন দেশ? এই যে আমরা এখন যে দেশে থাকি- 'বাংলাদেশ'। আগে এটা আমাদের 'বাংলাদেশ' ছিল না, এটা ছিল 'পাকিস্তান'। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা এই 'বাংলাদেশ' পেয়েছি। দাদু, মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কি রকম হয়? সুপারম্যানের মতো? হাসতে হাসতে বলেন- দাদু, আমাকে দেখতে কেমন বলো তো দাদুভাই? তুমি তো মানুষের মতো। মানুষের মতো নয়। আমি মানুষ। আর আমিই তোমার একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুমি কি দিয়ে যুদ্ধ করেছ দাদু, তোমার সঙ্গে কি দাদিও ছিল? আমার সঙ্গে তোমার দাদি ছিল না, তবে অনেক মহিলাও মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাদের মধ্যে তারামন বিবি, সেতারা বেগম, কাননবিবি, আরও অনেকে আছে দাদুভাই। আচ্ছা দাদু, বক্সিনের মতো যুদ্ধ করেছ? হাসতে হাসতে দাদু বলেন, না দাদুভাই- আমরা তো বন্দুক, লাটি, গোলাবারুদ দিয়ে যুদ্ধ করেছি। তাহলে তুমি বন্দুক চালাতে পারো? পারি তো। আমিও আব্বুকে বলে একটা বন্দুক কিনে নেবো। আমার বন্ধু সজীবের বন্দুক আছে। আমি কিনলে স্কুলে গিয়ে বন্দুক বন্দুক খেলব। দাদু তোমরা যুদ্ধ করেছ কেন? সে অনেক ইতিহাস দাদুভাই। পাকিস্তান যখন আমাদের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে লাগল, আমাদের ফসল, অর্থ-সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত পশ্চিম পাকিস্তান। যখন আমরা এর প্রতিবাদ করি, আমাদের অধিকার আমরা দাবি করি। তারা আমাদের দাবি তো মানেইনি বরং তখনি শুরু করে বাঙালিদের ওপর অমানবিক অত্যাচার। তখন প্রতিবাদ আরও জোরালো হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। ধীরে ধীরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আচ্ছা দাদু, বিজয় দিবস আর মুক্তিযুদ্ধ কি আলাদা? না দাদুভাই। মুক্তিযুদ্ধের যে দিনটিতে আমরা বিজয়ী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি, সেই দিনটিকে বিজয়ের দিন হিসেবে পালন করি। আরও সহজ করে বললে- বিজয় অর্থ-জয়লাভ করা, দিবস অর্থ- দিন। তাই বিজয় দিবস মানেই হলো- বিজয়ের দিন। আচ্ছা দাদু, তুমি কি আমাদের স্কুলে যাবে? হঁ্যা দাদুভাই, স্কুল খুললে আমি আবার তোমাদের স্কুলে গিয়ে তোমাদের গল্প শোনাবো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। এখন তুমি ঘরে গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। আচ্ছা দাদু, পরে আমরা ঘোড়া ঘোড়া খেলব। আর আমি কাগজ দিয়ে নৌকা আর ঘুড়ি বানাতে পারি। গানও গাইতে পারি। তোমাকে শেখাবো। আচ্ছা দাদু ভাই, তুমি আমাকে সব শেখাবে, এবার কিছু খেয়ে নাও। কাব্য বিজয়ের আনন্দ নিয়ে এক গাল পরিতৃপ্তির নির্মল হাসি নিয়ে মায়ের কাছে গেল।