গল্প

এক কিশোরের স্বপ্ন

প্রকাশ | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

মোস্তাফিজুল হক
অপুর খুব ইচ্ছে সে প্রত্নতাত্ত্বিক হবে। কেন সে প্রত্নতাত্ত্বিক হতে চায়, তারও একটা কারণ আছে- নিত্যনতুন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো যাবে, জানা যাবে বহু পুরনো ইতিহাস আর ঐতিহ্য। চাপা পড়েছিল এমন ঐতিহ্যের কোনোটার পাশে হয়তো তার নামও লেখা হবে। তাছাড়া এসব কাহিনী নিয়ে লেখা যাবে অনেক গল্প, কবিতা আর প্রবন্ধ। তবে অপু নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, 'তুই আবার গল্প-কবিতা কী করে লিখবি? মুখে মুখে দুই লাইন বললেই কি কবি হওয়া যায়?' অপু প্রায়ই মুখেমুখে ছড়া কাটে। যেমন: 'উজানপুরের সত্য মিয়া আইলো হাটে মোরগ নিয়া সত্যটা বে-খেয়ালি মোরগ নিল শেয়ালী!' এসব ছড়া শুনে সবাই হাসে। বলে, 'আহা রে, কবি! কবির ছেলে কবি!' কথাটা অপুর মনে খুব দাগ কাটে। তাই সে মনে মনে ভাবে, বাবা তো বেশ ভালো লিখেন! তবে কেন উপহাসের পাত্র হতে যাব? এসব ভেবেও সে ছড়া লেখার অদম্য ইচ্ছা পোষণ করে। ফলে ম্যাগাজিন, পত্রিকা আর পাঠাগার চর্চা খুব বেড়ে গেল। অপু এসব করার ফল হাতেনাতেই পেয়ে গেল। বার্ষিক পরীক্ষায় এক বিষয়ে পাস নম্বরই পেল না সে! বৃত্তিধারীর এই ফলাফল! অপুর বাবা ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি অপুকে ছড়া-পদ্য লিখতে নিষেধ করলেন। অপুও মনে মনে ঠিক করল, সে আর এপথে পা বাড়াবে না। বহু পুরনো নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে দেশে। এসবের অন্যতম একটি ওয়ারী বটেশ্বর। তবে অপু কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি, দেখাও হয়নি আজও তেমন কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন। দেখবেই বা কোত্থেকে? ছড়ায় ছন্দ পতনের মতো অপুর জীবনেও ঘটেছে ছন্দপতন। সে শিখেছে পরের লাভ-ক্ষতি নিকাশের খেলা। সুপার ক্লারিকেল সায়েন্স। অথচ সুযোগ পেলে সে সহপাঠীদের মতো অনেক কিছুই করতে পারত। এলাকায় এক রাজাকারের পঁচাত্তরের চক্রে আবারও ক্ষমতা বাড়তে থাকে। তার পরিচিতি ঘটতে থাকে পরোপকারী মহৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি হানাদারদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বহু মানুষের উপকার করেছেন। বুলেটের মুখ থেকে বাঁচাতে নাকি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ মৃতু্যর মুখোমুখি হয়েও নির্যাতন সয়েই বেঁচে গেছেন। তাই তিনি উপকারী মুসলমান। অপুর পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে সেই ধূর্ত রাজাকারের ভূমিকাও কম নয়। অপু তাকে দেখলেই বিরক্তিবোধ করত। অপু তখন ছয়ে পড়েছে। বাবার হাত ধরে মাঝে মাঝে স্কুলে যায়। হেমন্তের এক সকালে সেই উপকারী রাজাকার এলেন স্কুলে। তিনি সেদিন অপুর বাবাকে বললেন, 'মাস্টার চাচা, স্কুল মেরামত হয়- আমি জানি না! এইডা কেমন কথা?' তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলে খুব কটাক্ষ করেই জানতে চাইলেন। তিনি আরও বললেন, 'যা হওয়ার হইছে, আমার ভাগের পাঁচ হাজার টাকা সময় মতো পৌঁছাই দিয়েন।' জবাবে অপুর বাবা বললেন, 'স্কুল হলো ফুলের বাগান। এখানে যারা পড়তে আসে, তারা সবাই ফুলের কুঁড়ি। বাগানে ভালো ফুল ফোটাতে চাই উপযুক্ত পরিবেশ। আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা দিলে স্কুলের কাজ করাব কী দিয়ে?' 'বেশি কথা বইলেন না। মাস্টার, বেশি কথা বললে, খালুইয়ে তুইলা নাচামু।' কথাটা শোনে অপুর আব্বার আর সহ্য হয় না। তিনি মুখের ওপর বলে দেন, 'আপনি যা করার করবেন। আমি এ অন্যায় আব্দার মেনে নিতে পারব না।' স্কুলের পুরনো ছাদ ভাঙা হচ্ছে। ফাটা ছাদ ভেঙে নতুন টিনের ছাউনি দেওয়া হবে। এমন সময় চেয়ারম্যান সাহেব এলেন। তিনি এসেই বললেন, 'ওই মিয়ারা শুধুই ছাদ ভাঙছ কেন? পুরাটাই ভাইঙ্গা ফালাও!' শ্রমিক সর্দার বললেন, 'কিন্তুক স্যার যে খালি ছাদ ভাঙার কথা কইছে?' 'ধুর মিয়া, আমি হইলাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এক সময় এমএলএ আছিলাম। আমি কিনা জাইনা কইছি? দুইতলা নতুন বিল্ডিং হইব। ভাইঙা ফালাও।' স্কুল ভাঙার অপরাধে অপুর বাবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হলো। স্কুল গড়িয়ে দেওয়ার পরেও হয়তো জেলও হবে। শ্রমিকরা কেউ সত্যি কথা বলল না। বলবে কী করে? মিস্ত্রি, শ্রমিক আর দুয়েকজন সাক্ষীকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে, 'তোরা যদি কইছস চেয়ারম্যানের কথায় ভাঙছি, তাইলে তগো সব কয়ডারে জেল খাটামু। আমি হুকুম দিবার কেডা? তয় আমি সাক্ষী দিবার পামু, তোরা মাস্টারের হুকুমে দালান এক্কেবারে ভাইঙা ফালাইছস।' অপুদের ধানি জমি আর হালের বলদ বেচে দেওয়া হলো। এমনকি দুধের গাভিটাও বেচে দেওয়া হলো। বহু পুরনো বিশ্বাসী কাজের লোক নুরু। ওকেও বিদায় দিতে হচ্ছে। এখন যে আর হালচাষ নেই! কিন্তু নুরু বলল, 'দাদা, আমি যামু না। তয় বোজা অয়াও থাকমু না। বর্গাচাষ আর টালতরকারি করমু।' নুরু কেন যাবে? সে যেতে পারে না। সে চলে গেলে তার দুইকাঁধ ফাঁকা লাগবে। পিঠে দারুণ শূন্যতা অনুভূত হবে। এই শূন্যতা অপুর জন্য। কারণ, ও যখন হালচাষ করত, তখনও অপু ওর পিঠেই থাকত। ও যখন ক্ষেতে নিড়ানি দিত, তখনও অপু কাঁধেই বসে থাকত। দুই বছর কেটে গেল। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসে ঘটনা সরজমিনে তদন্ত করবেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই আদালতে রায় হবে। যথারীতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এলেন। কিন্তু সেই তিনি কিনা সবাইকে অবাক করে দিয়ে অপুর বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। অপুর বাবা বললেন, 'স্যার, করেন কী! করেন কী?' 'স্যার, আমি আপনার ছাত্র। এক সময়ের সার্কেল অফিসারের ছেলে। আপনি এমন কাজ কখনোই করতে পারেন না, স্যার। আমি আমার শৈশবের স্যারকে খুব ভালো করেই জানি', কর্মকর্তা জবাবে বললেন। অপুর বাবার মামলা নিষ্পত্তি হলো। অভাব অনটন হয়ে উঠল নিত্যসঙ্গী। ঐ একটি স্কুলেই তার সসম্মানে কেটে গেল চাকরির পুরোটা সময়। একদিন তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মাননা আর স্বর্ণপদকও পেলেন। তবে সেই স্বর্ণপদকে কোনো স্বর্ণ ছিল না। দুই বছর পর মেডেলে মরিচা ধরল। তার মতো শিক্ষকদের নিয়ে প্রকাশিত স্মরণিকাটা কে নিয়েছে গেছে জানা নেই! অপুর বাবা ডায়েরি ভরে ছড়া, পদ্য আর কবিতা লিখেছিলেন। বাবার মৃতু্যর পর অপু স্বপ্ন দেখে, সে তার বাবার বই প্রকাশ করবে। সেই বই-ই হয়তো তাকে ছড়ার প্রত্নতত্ত্ব থেকে বের করে এনে কবি না হলেও কবিপুত্রের মর্যাদা দেবে। বাবা মারা গেলে অপু কোথাও আর ডায়েরিটা খুঁজে পেল না। তবে কি ওর বাবা আড়ালে চাপা পড়ে যাবে? অপু মেনে নিতে পারে না। সে ছেচলিস্নশে এসে আবারও কলম হাতে তুলে নিল। তবে ততদিনে ওর সমবয়সিরা রাষ্ট্রীয় পদক জিতে ফেলেছে। অপু এখন তাদের ফলোয়ার। সে এখন ঠিক 'রুমাল চোর' গল্পের তিলকার বান্ধবী রুমুর মতোই লাজুক।