গল্প

হলুদের দিগন্ত

সুন্দর জিনিস দেখলে ছুঁতে ইচ্ছে করে, কাছে পেতে ইচ্ছে করে- তাই ছবি তুলবি ভালো কথা, কিন্তু গরিব মানুষের ফসল কেন নষ্ট করবি তোরা?

প্রকাশ | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মো.আজিজুল ইসলাম
মীম তার বাবা মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। গ্রামের অনন্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বেশ আনন্দিত সে। বিকালে বাবার সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সে দেখতে পেল বিশাল বড় ফসলের মাঠ হলুদ ফুলের আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। হলুদে হলুদে একাকার হয়ে যেন ছুঁয়ে গেছে নীল আকাশের দিগন্ত। ফুলগুলো তাদের কলি ভেদ করে সুভাস ছড়িয়ে ফুলপ্রেমীদের কাছে টেনে প্রকৃতির বুকে সৃজন করেছে অপার সৌন্দর্যের লীলা ভূমি। বাবা মীমকে জানালো এগুলো সরিষা ফুল। মীম আগে কখনো এমন সুন্দর এত ফুল একসঙ্গে দেখেনি। ছোট্ট মন অতি আনন্দে সরিষা ফুলের সতেজ ঘ্রাণে বিমোহিত হলো সে। খুশিতে আত্মহারা হয়েই বাবার নিষেধ অমান্য করে সে সরিষা ক্ষেতের এপাশ ওপাশ ছুটাছুটি করতে লাগলো। কচি ফুলের কোমল স্পর্শে ভালোলাগার শিহরণে শিহরিত হয় সে। হলদে রঙের নরম কচি ফুল ছিঁড়েছিঁড়ে সে কানে পড়ল আর মাথার চুলে গুঁজতে লাগল। মীম মনে মনে ভাবতে লাগলো সব ফুল ছিঁড়ে সে বাড়িতে নিয়ে যাবে। তাই সে ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ফ্রকের কোঁচ পরিপূর্ণ করে ফেলেছে। ফুলে ভর্তি ফ্রকের ছোট্ট কোঁচে যতই ফুল রাখছে জায়গা সংকীর্ণ হওয়ায় কোঁচ থেকে ফুলগুলো পড়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, তারপক্ষে এতগুলো ফুল নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই বাবার মোবাইল দিয়ে মনোরম দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করতে লাগল। ফুলের সঙ্গে সেলফি তুলছে আর একা একা আপন মনে কথা বলছে। পা দিয়ে সরিষা গাছগুলোকে এমনভাবে ভাঙতে লাগলো যেন শহরের আবদ্ধ খাঁচা থেকে গ্রামের অনন্য সৌন্দর্যে তার বাচ্চা মন আজ মুক্তি পেয়েছে। তার আঘাতে শত শত যুবতী-পোয়াতি সরিষা গাছ আহত নিহত হয়েছে। অবশ্য তার আশপাশে আরো অসংখ্য লোক তার মতো হলুদের রাজ্যে মেতে উঠেছে নব উৎসবের উন্মাদনায়। তারাও ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সরিষার মাঠ জুড়ে ভিড় করেছেন। কেউ ফটো তুলছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ ফুল ছিঁড়ছে, কেউ বা এপাশ ওপাশ ঘুরছে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মীম অনেক কষ্ট করে অনেক ছবির মধ্য থেকে বাছাই করে সরিষা ফুলের সঙ্গে তার তোলা সেরা ৫টি ছবি বাবাকে দেখিয়ে বলল, আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না বাবা? বাবা ছবিগুলো দেখে বলল, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। কিন্তু মা'মুনি এই ছবিগুলো যদি আমি ডিলিট করে দেই তাহলে তোমার কেমন লাগবে? আমি খুব কষ্ট পাব বাবা। তখন বাবা বললো, তুমি একজন কৃষকের কষ্টে ফলানো ফসল নষ্ট করেছ, ফুল ছিঁড়েছ, পা দিয়ে গাছগুলোকে পিষে মেরেছ, তোমার এই কাজে সে কি কষ্ট পাবে না? এই গাছগুলো তো তুমি আমি লাগায়নি, নিশ্চয়ই অন্য কেউ লাগিয়েছে। তুমি অন্যের ফুল গাছ কেন নষ্ট করেছ- মা'মুনি? ঠিক তখন তারা শুনতে পেল পাশেই একটি ছোট্ট ভাঙা বাড়িতে মীমের বয়সি একটা ফুটফুটে মেয়ে খুব কান্নাকাটি করছে আর মেয়েটি তার মাকে বলছে, আমার শীতের কোনো ভালো জামা নেই। এই শীতে আমার খুব কষ্ট হয় মা। তুমি আমাকে শীতের জামা কিনে দেও না কেন? আমার কষ্ট কি তোমার চোখে পড়ে না? মেয়েটির মা মেয়েটিকে বলে, কীভাবে দেব মা, অভাবের সংসার, তোদের ঠিকমতো ভাতই দিতে পারি না; আবার ভালো জামা? আমরাও কি শীতে কম কষ্ট করিরে মা। এবার সরিষার ভালো ফলন হয়েছে- তোর বাবাকে সরিষা বিক্রি করে সবার জন্য ভালো জামাকাপড় কিনে আনতে বলব। দোয়া কর মা, সাহেবদের ছবি তোলার হাত থেকে যেন সরিষা গাছগুলো বেঁচে থাকে। তখন মীম আর তার বাবা তাদের বাড়িতে গেল। মীমের বাবা বলল, যে সাহেবরা আপনাদের সরিষাক্ষেত নষ্ট করছে তাদের কিছু বলছেন না কেন? কি আর বলব, যারা এখানে ছবি তুলতে আসে সবাই বড়লোক আর ক্ষমতাশালী মানুষ। আমাদের কথা কি আর তারা শুনবে! সুন্দর জিনিস দেখলে ছুঁতে ইচ্ছে করে, কাছে পেতে ইচ্ছে করে- তাই ছবি তুলবি ভালো কথা, কিন্তু গরিব মানুষের ফসল কেন নষ্ট করবি তোরা? মীম তার বয়সি ছোট্ট মেয়েটিকে তার নিজের সুন্দর শীতের গরম জামাটি পরিয়ে দিল আর বলল,বাবা ওনাদের ফসলের যত টাকার ক্ষতি আমি করেছি, তুমি তাদের সব টাকা দিয়ে দাও। আমাদের তো অনেক টাকা আছে; তাই না বাবা? মীমের বাবা তাদের হাতে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বলল, আপনাদের ফসল আর কেউ নষ্ট করতে পারবে না। আপনাদেরও আর কষ্ট করতে হবে না। আমরা আপনাদের সব কষ্ট দূর করে দেব। মেয়েটির মা তখন চোখের পানি ফেলে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল, আপনাদের মতো মানুষ যদি এ দেশের প্রতি ঘরে ঘরে থাকতো...!