ভাবুকটা শহীদ মিনার আঁকবে

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আবুল কালাম আজাদ
লোকটার মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামা। পায়ে চটি জুতা। কাঁধে চটের ব্যাগ। কেমন ভাবুক টাইপের চেহারা। লোকটার নাম যেন কী? ধ্রম্নব নাকি এষ? নাকি এষ ধ্রম্নব? নাকি ধ্রম্নব এষ? শুনেছি ছবি-টবি আঁকে। কবিতা-টবিতাও লেখে বোধ হয়। লোকটা প্রায়ই এদিকে আসে। এসে ওই বেঞ্চিটার ওপর বসে থাকে। উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। মেঘ-টেঘ দেখে। আবার সামনের মাঠটায় পুচ্চিরা খেলা করে তা-ও দেখে। পুচ্চিরা তাকে একদম পাত্তা দেয় না। ভাবুক টাইপের মানুষের পাত্তা না দেওয়াই ভালো। আজও বসে আছে সে। আগের মতোই আকাশ-টাকাশ, মেঘ-টেঘ দেখা শেষ করে তাকাল পুচ্চিদের দিকে। আজ কিন্তু পুচ্চিরা খেলা করছে না। পানিতে কাদা গুলিয়ে কী যেন করছে। পাশে আবার স্তূপ করে রেখেছে পুরনো ইট। বোধ হয় কিছু একটা বানাবে। কাদায় মাখামাখি করে পুচ্চিদের অবস্থা যা হয়েছে না! মনে হচ্ছে, চলমান পুচ্চি-পুচ্চি মূর্তি। লোকটা ডাকল-অ্যাই পুচ্চি, এদিকে আয় তো। তোর সঙ্গে কথা আছে। একটা পুচ্চি বলল, কে, আমি আসবো? না, তোর পাশেরটা। যেটার বুকে, পিঠে, কপালে আর ঠোঁটে কাদা লেগে আছে। কাদামাখা পুচ্চিটা এসে বলল, কী কথা বলেন! সামনের ওই পাথরটায় বস। বসতে পারব না, কাজে ব্যস্ত। আরে একটু বস। শত ব্যস্ততার ফাঁকেও মাঝে মাঝে একটু বসতে হয়। বসেছি, এবার বলেন কী কথা। তুই কয় নাম্বার শ্রেণিতে পড়িস? দুই নাম্বার। তুই ইংরেজিতে কেমন? তুই তুই করে বলবেন না, তুমি করে বলেন। তুই করে বলতে আমার বেশি ভালো লাগে, বুঝলি? আপন আপন মনে হয়! তুই কয় নাম্বার শ্রেণিতে পড়িস? পুচ্চিটা বিড়বিড় করে বলল, অদ্ভূত লোক! মাত্রই বললাম আর ভুলে গেল। কী বললি বিড়বিড় করে? কিছু না। আমি দুই নাম্বার শ্রেণিতে পড়ি। তুই ইংরেজিতে কেমন? ভালো। তাহলে ইংরেজি কর- আমি আমার দেশকে খুব ভালোবাসি। আই লাভ মাই কান্ট্রি ভেরি মাচ। ধন্যবাদ। তুই বাংলায় কেমন? আরও ভালো। আরেকটা ধন্যবাদ। বলতো কাল কোন মাসের কয় তারিখ? ৯ ফাল্গুন, ২১ ফেব্রম্নয়ারি। কাল কী দিবস? শহীদ দিবস। কেন? ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরো অনেকে শহীদ হন। কারা মেরেছিল ওদের? পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানি না, বল কাপুরুষ পাকিস্তানি। ওরা সাহসী বাঙালিদের ওপর বারবার নির্যাতন চালিয়েছে। ভয় পেয়ে অস্ত্র ব্যবহার করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। আচ্ছা, সেদিন কেন মেরেছিল ওদের? ওরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে না নিয়ে মাতৃভাষা বাংলার জন্য মিছিল করেছিল বলে। বাহ! তুই তো দেখছি অনেক কিছু জানিস। ধন্যবাদ তোকে। আচ্ছা, কাল তোরা কী করবি? কী করব বোঝেন না? না। শহীদ মিনার বানাচ্ছি তাও বোঝেন না? কাল ভোরে আমরা সবাই প্রভাত ফেরিতে যাব। শহীদ মিনারে ফুল দেব। ফুলে ফুলে ঢেকে দেব শহীদ মিনার। গান গাইব-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি.....। তুই গানটা জানিস তো? যতটুকু গাওয়া হয়, ততটুকু জানি। আমরা সবাই জানি। বল তো শুনি। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।/ ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রম্নতে গড়া এ ফেব্রম্নয়ারি,/ আমি কি ভুলিতে পারি।/ আমার সোনার দেশের রক্তে গড়া-এ ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।/ আমি কি....। ধন্যবাদ তোকে। তোরা কোন শহীদ মিনারে ফুল দিবি? আপনার মাথায় কি মগজ নেই? কি অদ্ভূত কথা! মগজ থাকবে না কেন? তুই জানিস আমি ছবি আঁকতে পারি? মেঘের ছবি, একটা মেঘের উপর দিয়ে আরেকটা মেঘের উড়ে যাওয়ার ছবি। দোয়েল পাখির খাড়া লেজটা সবচেয়ে ভালো আঁকতে পারি। আর আঁকতে পারি শাপলা ফুল। লাল শাপলা, সাদা শাপলাও আঁকতে পারি। আর যা আঁকতে পারি শুনলে তুই অবাক হবি। আর পারি এক টানে রবীন্দ্রনাথ আঁকতে। একটা মাত্র টানে। মগজ না থাকলে কি এ সব আঁকা যায়? তাহলে বুঝে নিন কাল আমরা কোন শহীদ মিনারে ফুল দেব। সবাই কি সবকিছু বোঝে? রবীন্দ্রনাথই কি সবকিছু বুঝতেন? বল না, তোরা কাল কোন শহীদ মিনারে ফুল দিবি? আমরা যে কাদা মাখছি, এতগুলো ইট জোগাড় করেছি, তা কেন? সত্যিই তো, কেন? আমরা শহীদ মিনার বানাচ্ছি। ইট দিয়ে মিনার বানাব। ইট বিছিয়ে বেদি বানাবো। কাদা লেপে বেদিটাকে মসৃণ করব। তিন দিকে লাল, নীল, হলুদ ফিতা টেনে দেব। ফিতার মধ্যে ঝুলিয়ে দেব অ-আ-ক-খ। সামনের দিকটা খোলা থাকবে। সেদিক দিয়ে আমরা ফুল দেব। ফুলে ফুলে ভরে দেব বেদিটাকে। বলিস কি! তোরা তো যেন-তেন না। তোরা সবাই একেকটা হামিদুর রহমান। অ্যাই, কাল ভোরে আমি তোদের সঙ্গে ফুল দিতে আসব। তোদের সঙ্গে গাইব-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি। আমি কি......। আমার কণ্ঠটা ফাটা বাঁশ হলেও সুরটা ভালোই দিতে পারি। কাল শুনলেই বুঝতে পারবি। তারপর তোদের ফুলে ঢাকা শহীদ মিনারটার একটা ছবি আঁকব। সত্যি বলছি, আমি কিন্তু মন্দ আঁকি না। শুধু মাঝেমধ্যে লাল গোলাপকে গোলাপি করে ফেলি আর গোলাপিটাকে লাল। ঠিক আছে, আঁকতে চাইলে আঁকবেন। শুধু কি ঠিক আছে? একটা ধন্যবাদ দিবি না? আমি তোকে কতগুলো ধন্যবাদ দিলাম। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনে আমার অনেক সময় নষ্ট করেছেন। এতক্ষণ কত কাজ করতে পারতাম! আচ্ছা যা, তুই কাজ করগে। আমি একটু প্র্যাকটিস মানে চর্চা করি। লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগল- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।